ধরা পড়া দুই যুবকের একজন গত বছর চার মাস নিখোঁজ ছিলেন

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে মাজারের খাদেমকে খুনের কারণ ব্যক্তিগত আক্রোশ নাকি এটি মাজারবিরোধীদের কাজ, সেটি এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পর ধাওয়া দিয়ে স্থানীয় লোকজন যে দুই যুবককে ধরে পুলিশে দেন, তাঁদের একজন মো. ইলিয়াছ গত বছর কোরবানি ঈদের পর টানা চার মাস নিখোঁজ ছিলেন। পরে আবার তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। এ ছাড়া মাজারের একটি কক্ষে দুই বছর আগে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

আটকের পর স্থানীয় লোকজন ও পরে পুলিশের কাছে মো. ইলিয়াছ ও মোছলেহ উদ্দিন ওরফে সুজন দাবি করেন, বিদেশ যাওয়ার আশায় তাঁরা কয়েকবার মাজারে মোমবাতি জ্বালান। খাদেমকে তাঁদের জন্য তদবির করতে বলেন। কিন্তু তদবিরে কোনো কাজ না হওয়ায় খাদেমকে খুন করেন তাঁরা। অবশ্য বিদেশে যেতে মাজারে মানত করার বিষয়টি দুই যুবকের পরিবার জানে না।

গত বুধবার সন্ধ্যায় সোনাইমুড়ী উপজেলার নদনা ইউনিয়নের হাটগাঁও গ্রামে আফজাল শাহর মাজারের খাদেম সোনা মিয়াকে (৬৮) গলা কেটে হত্যা করা হয়। তাঁর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। ঘটনার পর ছোরা হাতে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ধাওয়া করে প্রথমে ইলিয়াছকে (২৪) আটক করে গণপিটুনি দেন। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইলিয়াছের সহযোগী সুজনকেও (২১) আটক করে পুলিশ। দুজনের কাছ থেকে দুটি ছোরা উদ্ধার করা হয়। দুজনের বাড়ি নদনা ইউনিয়নের উত্তর শাকতলা গ্রামে (বড়গাঁও নামেও পরিচিত)।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন দাবি করেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুফি মতাদর্শে বিশ্বাসী পীর-মাশায়েখদের ইতিপূর্বে যেভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে সোনাইমুড়ীতে মাজারের খাদেম হত্যার ঘটনাও একই সূত্রে গাঁথা। এতে বলা হয়, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকেও একই কায়দায় গলা কেটে হত্যা করা হয়।

বিবৃতিতে খাদেম হত্যার তীব্র নিন্দা জানান তরীকতের চেয়ারম্যান সাংসদ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং মহাসচিব এম এ আউয়াল। যুক্ত বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, বিভিন্ন দরবার ও মাজারে জঙ্গি গোষ্ঠী যে হামলা চালিয়েছে এটি তারই ধারাবাহিকতা। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদদাতা জঙ্গি গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করার দাবি জানান তাঁরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সোনাইমুড়ীর বড়গাঁও গিয়ে কথা হয় আটক দুই যুবকের পরিবারের সঙ্গে। ছোট বেলায় দুজনই হাফেজি পড়েন। তবে কেউই শেষ করেননি। ইলিয়াছের বাবা মো. নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে খাদেমকে খুন করতে পারে এটি তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না। তাঁর মেজ ছেলে আলী আকবরের নদনা বাজারে ফটোকপি ও কম্পিউটারের দোকান রয়েছে। আকবর বিদেশে চলে যাওয়ার পর দেড় বছর ধরে ইলিয়াছ দোকানটি চালাত। ছেলেকে কারও সঙ্গে মিশতে, আড্ডা দিতে দেখেননি তিনি। গত বছর ইলিয়াছ চার মাস নিখোঁজ ছিল। ফিরে আসার পর বলেছে, চট্টগ্রামে তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিল। তাঁরা ছেলের কথা বিশ্বাস করেন। বিষয়টি আর যাচাই করেননি।

ইলিয়াছের বাড়ি থেকে সুজনের বাড়ি প্রায় ৫০০ মিটার দূরে। সুজনের বাবা দুলাল মিয়া গতকাল দুপুরে বাড়িতে ছিলেন না। সুজনের মা ছালেহা বেগম বলেন, হাফেজি পড়া শেষ করে চার-পাঁচ বছর আগে মাদ্রাসা থেকে বের হয়েছেন সুজন। পরে রংমিস্ত্রির কাজ নেন। আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে সৌদি আরব কিংবা কাতার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল সুজনের। কিন্তু এ জন্য তদবির করতে মাজারে যাওয়ার কথা কখনো শোনেননি তিনি। ছেলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মিশত না। তবে ইলিয়াছের দোকানে মাঝেমধ্যে যেত।

উত্তর শাকতলা ওয়ার্ডের (৫ নম্বর ওয়ার্ড) ইউপি সদস্য আবুল কালাম বলেন, এলাকায় কোনো খারাপ কাজে ওই দুই যুবক জড়িত ছিলেন না। কিন্তু অন্য গ্রামে গিয়ে মাজারের খাদেমকে হত্যা করার খবর শুনে সবাই হতবাক। বিশেষ কোনো কারণ ও পরিকল্পনা ছাড়া তাঁরা এই ঘটনা ঘটানোর কথা নয়।

গতকাল বিকেলে হাটগাঁও গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আফজাল শাহর মাজার প্রাঙ্গণে দূর-দূরান্ত থেকে আসা উৎসুক নারী-পুরুষের ভিড়। মাজারের পাশের বাড়ির গৃহবধূ লাইলী বেগম বলেন, এখানে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। খাদেমের হত্যার ঘটনায় সবাই আতঙ্কিত।

মাজারের পাশেই একটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকতেন খাদেম। তাঁর স্ত্রী নিলুফা বেগম বলেন, বুধবার সন্ধ্যার পর দুই যুবক এসে খাদেমকে ডাক দেয়। তিনি ঘর থেকে বের হলে ওই যুবকেরা মাজারে মোমবাতি জ্বালানোর কথা বলে চারটি মোমবাতি নেয়। কিছুক্ষণ পরই বাইরে থেকে তিনি ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুনতে পান। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন মাজারের পাশে তাঁর স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। নিলুফা বলেন, চার দিন আগেও এই দুই যুবক এসেছিল। তারা বিদেশ যেতে পারলে মাজারে একটি গরু দেবে বলে খাদেমকে জানিয়েছিল।

হত্যাকাণ্ডের সময় মাজারের সামনের বাড়ির ভেতরে ছিলেন আফজাল শাহর (যার নামে মাজার) নাতি জিয়া উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগে মাজারের একটি ঘরে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। গত বছর শীতের সময় এক রাতে মাইজভান্ডারির গান বাজানোয় কিছু যুবক খাদেমকে গালমন্দ করে। আগুন লাগানো ও খাদেমকে গালমন্দ করার ঘটনার সঙ্গে এই খুনের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে জিয়া উদ্দিন মনে করেন। বিষয়টি পুলিশকেও জানিয়েছেন তিনি।

মাজারে আগে-পরে কেউ কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দুই যুবকের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারকে মামলা করতে বলা হয়েছে।