যেন স্বপ্নে পাওয়া ঘর

বন্যায় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বানুপাড়ায় আঞ্জুয়ারা ও আইনুল হক দম্পতির মাটির ঘর ধসে গিয়েছিল। প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় তাঁদের একটি নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। ঘরটি গতকাল হস্তান্তর করা হয় l ছবি: মঈনুল ইসলাম
বন্যায় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বানুপাড়ায় আঞ্জুয়ারা ও আইনুল হক দম্পতির মাটির ঘর ধসে গিয়েছিল। প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় তাঁদের একটি নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। ঘরটি গতকাল হস্তান্তর করা হয় l ছবি: মঈনুল ইসলাম

বন্যাবিধ্বস্ত বসতঘরের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে হাহাকার নয়, বরং সেখানে এখন নতুন ঘরের ঝা-চকচকে টিনের ঝলক। সেই ঝলক যেন ঠিকরে পড়েছে অন্তঃসত্ত্বা আঞ্জুয়ারার চোখেমুখে। ঘরের চাবি হাতে পেয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে আঞ্জুয়ারা বললেন, ‘নয়া ঘর পায়া মনে হওচে এইটা যেন স্বপ্নে পাওয়া ঘর।’ বললেন, ‘বন্যায় ঘর পড়ে গেছে, দুটো ছোট ছেলে, পেটে আরেকটি বাচ্চা, থাকার ঘরদুয়ার নাই, কী-যে কষ্টে ছিলাম। আল্লাহ তোমাদের ভালো করবে।’

আঞ্জুয়ারা বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বানুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। বন্যায় তাঁদের মাটির বসতঘরটি ধসে যায়। একমাত্র বসতঘরটি হারিয়ে দুই শিশুসন্তান ও স্বামীকে নিয়ে অনেকটা খোলা আকাশের নিচে কষ্টে দিন পার করছিলেন তিনি। প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে তাঁকে তৈরি করে দেওয়া হয় বারান্দাসমেত টিনের একটি ঘর। গতকাল সোমবার ওই ঘরের চাবি তাঁর হাতে তুলে দেন দক্ষিণ মোকসেদপুর খিয়ারডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল ওয়াদুদ। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আফতাবগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসার শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক এম এ মতিন সরকার। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে আঞ্জুয়ারাকে দেওয়া হয় নতুন শাড়ি, তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নতুন জামা, প্যান্ট, স্যান্ডেল ও স্বামীকে দেওয়া হয় পাঞ্জাবি।

বন্যার্তদের সহায়তার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্টকে ঢাকা লেডিস ক্লাব (ইস্কাটন) এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। গতকাল এই অনুদানের টাকা প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ক্লাবের পক্ষে ছিলেন (বাঁ থেকে) তাহমিনা হক (ক্রীড়া সম্পাদিকা), ডেইজী নাসিম (সমাজকল্যাণ সম্পাদিকা), জামান আরা মান্নান (সভাপতি), খায়রুন রাজ্জাক (খাদ্য সম্পাদিকা), রাফিয়া আবেদিন (সদস্য)। সর্ব বাঁয়ে বন্ধুসভার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাইদুজ্জামান l ছবি: প্রথম আলো
বন্যার্তদের সহায়তার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্টকে ঢাকা লেডিস ক্লাব (ইস্কাটন) এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। গতকাল এই অনুদানের টাকা প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ক্লাবের পক্ষে ছিলেন (বাঁ থেকে) তাহমিনা হক (ক্রীড়া সম্পাদিকা), ডেইজী নাসিম (সমাজকল্যাণ সম্পাদিকা), জামান আরা মান্নান (সভাপতি), খায়রুন রাজ্জাক (খাদ্য সম্পাদিকা), রাফিয়া আবেদিন (সদস্য)। সর্ব বাঁয়ে বন্ধুসভার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাইদুজ্জামান l ছবি: প্রথম আলো

আঞ্জুয়ারা জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তাঁরা দুই সন্তানসহ পেটের সন্তানকে নিয়ে দুই দিন না খেয়ে থাকার পর ঘরে থাকা স্টিলের একটি বাক্স ২ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন।

আঞ্জুয়ারার স্বামী আইনুল হক বলেন, ‘আমি ইটভাটায় কাজ করি। এখন ভাটা বন্ধ। বন্যায় এলাকার ধান পচে গেছে। কাজ নাই। তাই এত কষ্ট। নতুন ঘর তৈরি করে না দিলে আমরা কোনোভাবেই ভিটায় থাকতে পারতাম না।’

প্রতিবেশী দেলজান বেগম বলেন, ‘আঞ্জুয়ারা খুব ভালো মেয়ে। বন্যায় ঘর ভেঙে যাওয়ার পর পেটে সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে ছিল। ওর স্বামীর হাত চললে পেট চলে, না চললে বন্ধ থাকে।’

প্রতিবেশী আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আর যাই হোক ওদের একটা থাকার ঘর হলো। এতে আমরাও ভীষণ খুশি।’

এ ছাড়া প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে বন্ধুসভার ব্যবস্থাপনায় গতকাল দেশের ছয় জেলায় বন্যার্তদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয়প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

নওগাঁ

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ইসপুর ইউনিয়নের বাদাল, চানপুর, পূর্ব তাহেরপুর ও পূর্ব চন্দ্রপুর গ্রামের বন্যাদুর্গত ১০০টি পরিবারের মাঝে গতকাল সোমবার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়।

ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল পরিবারপ্রতি তিন কেজি চাল, এক কেজি আলু, আধা কেজি সয়াবিন তেল, আধা কেজি ডাল ও আধা কেজি লবণ। ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা করেন ধামইরহাট চকময়রাম মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খেলাল-ই-রব্বানী, ধামইরহাট ডিগ্রি কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রদর্শক হারুন আল রশীদ ও ইসপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাখাওয়াত হোসেন।

ত্রাণ পেয়ে পূর্ব তাহেরপুর গ্রামের রওশন আরা বলেন, ‘বানেত হামার ঘোরদোর, খ্যাতের ফসল সব গেছে। ম্যানষের বাড়ির বারান্দাদ আত্তিরে ঘুমাচ্ছি। চাল, ডাল, আলু প্যায়া দুটা দিন অ্যানা শান্তি করে খ্যাতে পামু।’

নবাবগঞ্জ (ঢাকা)

গতকাল সোমবার উপজেলার বিলাশপুর, নারিশা ও মুকসুদপুর ইউনিয়নের শতাধিক পানিবন্দী পরিবারের মাঝে এ ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল পাঁচ কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি আলু, এক কেজি লবণ, এক প্যাকেট বিস্কুট ও দুটি করে খাবার স্যালাইন।

‘ঈদের আগে ত্রাণটা পাইয়া ভালোই হলো। পাঁচ-ছয় দিন খেতে পারব। গত ১৫ দিন ধইরা পানিতে তলাইয়া আছি, কেউ আমাগো খবর নিতে আহেনা।’ ত্রাণ হাতে পেয়ে এ কথা বললেন, দোহারের নারিশা ইউনিয়নের নারিশা জোয়ার চর এলাকার বৃদ্ধ ছাহেরা খাতুন (৯০)।

 জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সহসভাপতি মো. সোহাগ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল-নোমান ও নবাবগঞ্জ বন্ধুসভার সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

মাদারীপুর

মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ও দক্ষিণ বিরাঙ্গল এলাকায় নদীভাঙন এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় চার কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক লিটার তেল, মুড়ি, তালমিছরি ও শিশুদের জন্য বিস্কুট।

মাদারীপুর জেলা পরিষদের সদস্য ফারুক খান বন্ধুসভার ত্রাণ বিতরণকাজে যুক্ত হন। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বন্ধুসভার উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম খান, মানবসম্পদ সম্পাদক বাঁধন খান প্রমুখ।

পার্বতীপুর (দিনাজপুর)

দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার পার্বতীপুর শহর, হলদিবাড়ি দোলাপাড়া, চণ্ডীপুর ইউনিয়নের তালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও হাবড়া ইউনিয়নের রামরায়সদুরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০ বন্যার্ত পরিবারকে দেওয়া হয় ত্রাণসমাগ্রী। এর মধ্যে ছিল চাল, ডাল, লবণ, আলু, বিস্কুট ও সাবান।

ত্রাণ বিতরণকাজে সহযোগিতা করেন পার্বতীপুর পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল ইসলাম, রামরায়সদুরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুমা দেবী প্রমুখ।

পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও)

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরচুনা ইউনিয়নের সিরাইল, ডাঙ্গাপাড়া, কাটাবাড়ি, বিদ্ধই ও খেকিডাঙ্গা গ্রামের ১৭৫ জন নারী-পুরুষকে গতকাল সোমবার ত্রাণ দেওয়া হয়। প্রতি পরিবারের জন্য ছিল চার কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি লবণ ও দুটি খাবার স্যালাইন। সিরাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বন্যার্তদের হাতে ত্রাণ তুলে দেন পীরগঞ্জ সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. বদরুল হুদা, সিরাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি রেজাউল করিম এবং প্রধান শিক্ষক আফতারুল ইসলাম। এ সময় ত্রাণ বিতরণে সহায়তা করেন বৈরচুনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ, পীরগঞ্জ উদীচীর সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বন্ধুসভার সভাপতি হৃদয় নাথ অধিকারী, সম্পাদক আজিজুল হক, সদস্য সাকিব আহবান, আলমগীর হোসেন, মেহেদী হাসান প্রমুখ।

শরীয়তপুর

গতকাল সোমবার শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পাঠানবাড়ি এলাকায় শের আলী মাদবরকান্দি, ঈশ্বরকাঠি, মূলপাড়া ও চেরাগ আলী ব্যাপারীকান্দি গ্রামের ১০০ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়। তাদের চাল-ডালসহ ১০ কেজি খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়।

শের আলী মাদবরকান্দি গ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোনা মিয়া ব্যাপারীর বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বোন রূপবান বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। বোনের সংসারেও অভাব-অনটন। সোনা মিয়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। নদীভাঙনের পর উপজেলা প্রশাসন সাহায্য করেছিল। তা দিয়ে কয়েক দিন চলেছে ওই পরিবারের। প্রথম আলোর ত্রাণ পেয়ে তারা খুব খুশি।

বন্যা ত্রাণ তহবিল

গতকাল যাঁরা সহায়তা করেছেন

ঢাকা লেডিস ক্লাব ১ লাখ, নারায়ণগঞ্জের বন্ধুমহল ক্যানটিন ৬২ হাজার, অংশু সামাজিক সংগঠন ৩১ হাজার ৪২০, মেগনাম কার্গো লিমিটেড ১৫ হাজার, নাইরিন আহসান ও ফারিয়া আহসান ১২ হাজার, নাহার কামাল আহমেদ ১০ হাজার, শফিকুল ইসলাম ১০ হাজার, ফারহান শাহরিয়ার ১০ হাজার, হাবিবুল্লাহ খান ওয়াক্ফ এস্টেট ১০ হাজার, জান্নাতুন নাহার মিতফা ৭ হাজার, তাহমিনা হক ৭ হাজার, ফারজানা নাজ ৫ হাজার, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৫ হাজার, নিশাত আলম তুবা ১ হাজার টাকা এবং সরাসরি ব্যাংকে জমা ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ টাকা।

* গতকাল মোট জমা

৫,৬২,৮২০ টাকা

এ পর্যন্ত মোট জমা

৫০,৩৪,৩৩৭ টাকা

*২২ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত বিতরণ ৪৮,০৭,০৮২ টাকার ত্রাণ।

তহবিলে অর্থ সহায়তার জন্য

প্রথম আলো ট্রাস্ট: ত্রাণ তহবিল

হিসাব নম্বর ২০৭-২০০-১১১৯৪

ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড

কারওয়ান বাজার শাখা।