রোহিঙ্গা পারাপারে বাণিজ্য

অবৈধভাবে রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ করতে প্রশাসন অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অভিযানের সময় আটক নৌকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছবিটি গত শুক্রবার শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া সৈকত থেকে তোলা l প্রথম আলো
অবৈধভাবে রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ করতে প্রশাসন অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অভিযানের সময় আটক নৌকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছবিটি গত শুক্রবার শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া সৈকত থেকে তোলা l প্রথম আলো

দমদমিয়া প্রাথমিক স্কুলের মাঠে গাছতলায় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে ছিলেন প্রৌঢ় নূর মোহাম্মদ। গতকাল নাফ নদী পেরিয়ে আসা শ তিনেক নানা বয়সী রোহিঙ্গা এখানে সাময়িক যাত্রাবিরতি দিয়েছে। স্কুলেরই একটি ঘরে স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী চাঁদা তুলে খিচুড়ি রান্না করছিলেন অনাহারী মানুষদের জন্য। নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যদের পোশাক-আশাক আর বাক্স-পোঁটলা দেখে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা মনে হলো। তাঁরা একটু আলাদা করেই বসেছেন গাছতলায়।

ঘরবাড়ি ছাড়ার দুঃখের ভেতরে আরও এক দুঃখের কথা শোনালেন নূর মোহাম্মদ। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে গত শুক্রবার দিবাগত রাত আনুমানিক দুইটার দিকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মংডুর হাসসুরাতা সীমান্ত থেকে নৌকায় উঠেছিলেন। অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। মংগদুর গর্জনদিয়া গ্রামে কাঠের দোতলা বাড়ি, মুদিখানা, প্রায় চার একর জমি, গরু-ছাগল—এসব ছিল। সব ফেলে রেখে নাফ নদী পার হওয়ার জন্য মাঝিদের সঙ্গে দরদাম ঠিক হয়েছিল জনপ্রতি বাংলাদেশি ৫ হাজার টাকা (লেনদেন হয়েছে সঙ্গে থাকা মিয়ানমারের টাকায়)।
মোট ১১ জন রোহিঙ্গা উঠেছিল ওই নৌকায়। মাঝ দরিয়ায় আসার পর মাঝিরা জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা দাবি করে বসেন। টাকা দিতে রাজি না হলে একপর্যায়ে নৌকা উল্টে দিতে উদ্যত হন। অনেক কাকুতি-মিনতি করে ৮ হাজার টাকায় রফা করে ভোররাতে তাঁরা শাহপরীর দ্বীপে নেমেছেন। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাঁরা একটু অবস্থাসম্পন্ন, তাঁদের অধিকাংশই মাঝিদের এমন জবরদস্তিতে পড়ছেন নদী পার হতে গিয়ে।

মাছ ধরা বন্ধ, রোহিঙ্গা ধরা লোভনীয় ব্যবসা

গত ২৫ অক্টোবরথেকে টেকনাফের জেলেদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিজিবি-২-এর কমান্ডার লে. কর্নেল এস এম আরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য। কার্যত অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। মাছ ধরা বাদ দিয়ে জেলেদের একটি অংশ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যবসায় লেগে পড়েছে।

টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমরান উদ্দিন চৌধুরী বললেন, এখানে নিবন্ধিত মাছ ধরার নৌকা ১ হাজার ৩৪৭। এখন অধিকাংশ নৌকাতেই রোহিঙ্গা পার করা হচ্ছে। সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর হোসেনের মতে, অন্তত ৮০০ নৌকায় রোহিঙ্গাদের আনার ব্যবসা চলছে। এসব মাঝির সঙ্গে যোগ দিয়েছে টেকনাফ থেকে নৌকায় মালয়েশিয়ায় আদম পাচারকারী একটি চক্র। মাঝারি নৌকায় ১০ থেকে ১২ এবং বড় নৌকায় ৩৫ থেকে ৪০ জন লোক তোলা হয়। কম করে হলেও প্রতিবার তাঁদের ১ লাখ টাকা আয় হয়।

টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, জাহাজপুরা, কাটাবানিয়া, মাথাভাঙ্গা, শীলখালী—এসব এলাকার মাছ ধরার নৌকাগুলো কোনো কারণে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সাধারণত নোঙর করে রাখা হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব ঘাটে এখন হাতে গোনা কয়েকটি নৌকা রয়েছে। কোনো কেনো ঘাটে একটিও নেই। রোহিঙ্গারা নৌকায় করে টেকনাফের হোয়ইক্যাং, হ্নীলা, সাবরাং ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে শহরে ঢুকে পড়ছে।

হোয়ইক্যাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, দুই দিন ধরে এই ইউনিয়নের লম্বা বিল এলাকা দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে ছোট ছোট নৌকায় করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। ছোট আকারের নৌকাগুলো মিয়ানমারের আরাকানিদের। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের নৌকা ওদিকে যেতে দেয় না, কিন্তু আরাকনিদের নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের এদিকে পাঠিয়ে দিতে সাহায্য করে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়। কিন্তু কিছু অসাধু লোক রোহিঙ্গা পারাপার করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে ইউপি চেয়ারম্যানরা তাঁকে জানিয়েছেন। অবৈধ পারাপারের অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৩টি নৌকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঘরে ২২ বস্তা চাল রেখে এখন অনাহারী

টেকনাফ শহরের কাঁচাবাজার এলাকায় একটি বিপণিবিতানের বারান্দায় সপরিবার বসে ছিলেন মংডুর কাদির বিল গ্রাম থেকে আসা শামসুল আলম। তাঁর বয়স প্রায় ৬৫ বছর। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ছয়জনের পরিবার। তিনি বেশ অবস্থাসম্পন্ন, সাড়ে সাত একর জমি ছিল। কাঠের বাড়ি। ঘরে মজুত ২২ বস্তা চাল। অথচ সপ্তাহখানেক ধরে একবেলা খেয়ে কোনো রকমে দিন যাচ্ছে তাঁর। শুকনো চিঁড়া-মুড়ি বা পলিথিনের প্যাকেটে খিচুড়ি পেলে সেগুলোই খাচ্ছেন। শামসুল আলম ও তাঁর মতো কারও কারও হাত বাড়িয়ে এসব নিতে সংকোচ হচ্ছে।

নারীর লজ্জা, নারীর কষ্ট

মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। দিনের পর দিন গোসল নেই, শৌচকর্মের ব্যবস্থা নেই। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে রয়েছে। বিশেষ করে নারীদের শৌচকর্মের কষ্ট অবর্ণনীয়। নয়াপাড়া এলাকায় সড়কের পাশে অনেকের সঙ্গে বসে থাকা সুরাইয়া খাতুন বললেন, আট দিন ধরে তিনি গোসল করতে পারেননি। পুরুষ ও শিশুরা তবু একটু আড়ালে আবডালে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে নিতে পারে। কিন্তু নারীরা পারছেন না। অপেক্ষা করতে হচ্ছে রাত নামার জন্য।

নিষেধে বাঁধা জীবন

গত তিন দিনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বহু বছর ধরেই তাঁরা আকারানে হরেক রকমের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে একরকম বন্দী জীবনযাপন করছিলেন। আরাকানের প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি থানায় চেকপোস্ট আছে। বছর দুই ধরে এসব চোকপোস্টের সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। লাল কার্ডধারীদের কোনো অসুবিধা নেই, তারা কার্ড দেখিয়ে সারা দেশেই যেতে পারে। কিন্তু সবুজ কার্ডধারী বা যাদের কার্ড নেই, তারা নিজের গ্রামের সীমানা পার হতে পারে না।

রোহিঙ্গাদের জমিজমার কোনো দলিল নিবন্ধন হয় না। বংশপরম্পরায় তাঁরা যে জমিজমা পেয়েছেন, তার একরকমের লিখিত কাগজ আছে। জমি বিক্রি করতে হলে নিজেদের মধ্যে মৌখিকভাবেই তা সম্পন্ন করতে হয়। একইভাবে রোহিঙ্গাদের বিয়ে নিবন্ধনও হয় না। তবে বিয়ের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের লিখিত অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই অনুমতির জন্য বর-কনের পক্ষে ২ লাখ ‘কিয়েট’ (মিয়ানমারের টাকা) জমা দিতে হয়।

রোহিঙ্গাদের উচ্চশিক্ষারও কোনো সুযোগ নেই। টেকনাফে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এসএসসি পাস (তাঁরা বলেন দশ ক্লাস) কাউকে পাওয়া যায়নি। কয়েকজন কিশোরকে পাওয়া গেছে, যাদের একজন সর্বোচ্চ নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়েছে। খায়রুল আলম নামের এই কিশোর জানায়, মংডুতে কোনো কলেজ নেই। কলেজে পড়তে আকিয়াবে যেতে হবে। সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।