মায়ের হাত থেকে বাসের চাকায়

দুর্ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্রী তাসনিম আলমের জন্য তার মা কাফরুল থানার করিডরে বিলাপ করছেন। এ সময় স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন l প্রথম আলো
দুর্ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্রী তাসনিম আলমের জন্য তার মা কাফরুল থানার করিডরে বিলাপ করছেন। এ সময় স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন l প্রথম আলো

স্কুল থেকে ফিরছিল মেয়েটি। মায়ের হাত ধরে পার হচ্ছিল রাস্তা। মা তাকে হাতে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর তুলছিলেন। কিন্তু দ্রুত ছুটে আসা বাস মায়ের হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে চাকায় পিষে ফেলেছে ১২ বছরের মেয়েটিকে। তার নাম তাসনিম আলম তিশা। গতকাল মঙ্গলবার বেলা দেড়টায় মিরপুরের কাজীপাড়ায় হাসপাতালের কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

ক্ষুব্ধ হয়ে এলাকার লোকজন সড়ক অবরোধ করেন। কয়েকটি বাস ভাঙচুর করা হয়। একটি বাসে দেওয়া হয় আগুন। পুলিশ বাসের চালককে আটক করেছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মিরপুর ১০ নম্বরের গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীতাসনিম তার মা রিমাআক্তারের সঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিল। রাস্তাটি তখন ফাঁকা ছিল। লাইফ এইড স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে রিমা বেগম এক হাতে তাসনিম ও অপর হাতে তাসনিমের পাঁচ বছর বয়সী ভাইকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তিনি শুরুতে ছেলেকে সড়ক বিভাজকের ওপর তোলেন। এরপর মেয়েকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর তুলছিলেন। এরই মধ্যে বেপরোয়া গতিতে ছুটে এসে তেঁতুলিয়া পরিবহনের একটি বাস তাসনিমের শরীরে ধাক্কা দেয়। এ সময় মেয়েটি ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলে চালক তার ওপর দিয়ে বাসটি চালিয়ে দেন। এতে মেয়েটির সারা শরীর থেঁতলে যায় এবং মাথার মগজ বেরিয়ে আসে।

তাসনিম আলম
তাসনিম আলম

মায়ের বুকফাটা চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে বাসটি ঘিরে ফেলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন বলেন, তেঁতুলিয়া পরিবহনে একজন পুলিশ যাত্রী ছিলেন। তিনি চালককে আটক করলেও চালকের সহকারী পালিয়ে যান।
তাসনিম তার মা-বাবার সঙ্গে ৬৪৪/৭ পশ্চিম কাজীপাড়ায় থাকত। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে বড়। বাবা খোরশেদ আলম বাসার কাছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
কাফরুল থানার সামনে রাখা অ্যাম্বুলেন্সে গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত পড়ে ছিল তাসনিমের নিথর দেহ।

মেয়ের শোকে মা রিমা আক্তার থানায় কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে থানার করিডরে স্বজনদের জড়িয়ে বিলাপ করছিলেন তিনি। চিৎকার করে বলে উঠছিলেন, ‘আমার তিশা, তুই কই গেলি? আল্লাহ, তুমি তো সব পারো। আমার মেয়েটারে ফিরিয়ে দাও। ওর তো দুপুরে ভাত খাওয়ার কথা ছিল।’
অশ্রুসিক্ত তাসনিমের বাবা বলেন, ‘ভাই, আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’
খবর পেয়ে গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের কয়েকজন শিক্ষক থানায় ছুটে আসেন। তাঁরা তাসনিমের মা-বাবাকে সমবেদনা জানান।
ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মোবারক হোসেন বলেন, ‘তাসনিম স্কুলের প্রভাতি শাখার পারুল সেকশনে পড়ত। সে শান্ত স্বভাবের ছিল। স্কুলে নিয়মিত আসত।’
ঘটনার পরপরই শত শত মানুষ সড়ক অবরোধ করেন। তাঁরা বাসটিতে আগুন লাগিয়ে দেন।

মোবারক হোসেন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, অবরোধে কাজীপাড়ার দুদিকে আটকে পড়া তেঁতুলিয়া পরিবহনের অনন্ত পাঁচটি বাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালান ক্ষুব্ধ লোকজন। এক ঘণ্টা ধরে এ অবস্থা চললে কাজীপাড়া থেকে মিরপুর ১০ নম্বর ও আগারগাঁও পর্যন্ত দুদিকের রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
তেঁতুলিয়া পরিবহন উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত যাত্রী আনা-নেওয়া করে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত কাফরুল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসলাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিক্ষুব্ধ জনতা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দিলে পরে তা নিভিয়ে ফেলা হয়। কাফরুল থানার পুলিশ চালককে শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বেলা তিনটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

স্বজনেরা বলেন, রংপুরের পীরগঞ্জে তাসনিমের লাশ দাফন করা হবে। স্বজনেরা মা-বাবাকে ধরাধরি করে লাশবাহী গাড়িতে তুলে দেন।

কাফরুল থানার পরিদর্শক আসলাম উদ্দিন বলেন, বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে প্রাণহানির ঘটনায় আটক বাসচালক আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৭৯ ও ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা হয়েছে। দুটি ধারাই রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানি ঘটানোসংক্রান্ত। দুটি ধারাতেই সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর কারাদণ্ড।