অমানবিক আচরণ বন্ধ করুন

রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ের শরণার্থী শিবিরে l বাসস
রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ের শরণার্থী শিবিরে l বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা জনগণের ওপর অমানবিক আচরণ বন্ধ করে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নেপিডোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়, তবে অন্যায়-অবিচার সহ্য করবে না।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমার থেকে আশ্রয়ের জন্য আসা মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণকালে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় আধা ঘণ্টা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শেখ রেহানা এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

শরণার্থীদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী রাখাইন সম্প্রদায়ের জনগণের প্রতি অত্যাচার বন্ধ এবং বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের শরণার্থীদের দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের শরণার্থীদের পাশে রয়েছি এবং তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাব, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের দেশে ফিরছে আমরা পাশে রয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘তারাও মানুষ এবং মানুষ হিসেবেই তাদের বাঁচার অধিকার রয়েছে। তারা কেন এত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে?’

শেখ হাসিনা বলেন, রাখাইন সম্প্রদায়কে তাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করার কোনো অধিকার মিয়ানমারের নেই। এক দেশের নাগরিকদের অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ সেই দেশের জন্যই অসম্মানজনক আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের দেশে ফেরত নেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে যদি সবার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা সরকার বিধান করতে পারে, সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের শরণার্থীদেরও কোনো সমস্যা হবে না। আগত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখানে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যদি ফায়দা লোটার চেষ্টা করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব আশ্রিত জনগণের সঙ্গে কোনো অস্থির বা অমানবিক আচরণ করা যাবে না।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রশ্নে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পুনরুল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো রকমের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আমরা মেনে নেব না। আমাদের মাটি ব্যবহার করে কেউ সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদী কাজ করবে, তা-ও আমরা কখনো বরদাশত করব না।’

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ও শেখ রেহানার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা দুই বোন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মা, বাবা, ভাই—সব হারানোর পর রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে বাধ্য হয়েছি। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল, তখন আমাদের দেশের মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আজকের যারা নতুন প্রজন্ম, তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সেই অত্যাচার-নির্যাতন দেখেনি। কিন্তু আমরা যারা দেখেছি, তারা স্মরণ করতে পারি কী ভয়াবহ ছিল। তাই এই শরণার্থীদের প্রতি আমি সবাইকে সদয় হতে বলব।’

প্রধানমন্ত্রী শরণার্থীদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেন। এ সময় শরণার্থীরা তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে পেয়ে মিয়ানমারে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন। এ সময় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

পরে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সার্কিট হাউসে জনপ্রতিনিধি, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি মিয়ানমারের শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ এবং অন্যান্য বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে বেসামরিক প্রশাসন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে নির্দেশ দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে পরামর্শসহ সমন্বয়ের বিষয়টি দেখাশোনা করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে পুরো ত্রাণ তৎপরতা ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিতভাবে সামাল দেওয়া যায়।

শেখ হাসিনা দেশে নিষিদ্ধ পণ্য অথবা অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচার রোধে শরণার্থী এবং ত্রাণকর্মীদের মালামাল ও লাগেজের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। প্রত্যেক শরণার্থীকে পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন, যাতে তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের সূত্র ধরে কক্সবাজারে কেউ যাতে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, মিয়ানমারের সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশেও গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

যেসব রোহিঙ্গা শিশু রোগে ভুগছে এবং সংঘাতে বাবা-মা হারিয়েছে, তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এসব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ত্রাণ তৎপরতা তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে এসব কর্মকাণ্ডে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ত করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে গতকাল দুপুরে আসে একটি রোহিঙ্গা পরিবার। নৌকা থেকে মালপত্র নামানোর আগে শিশুসন্তানকে তুলে দেওয়া হচ্ছে মায়ের হাতে l  ছবি: আশরাফুল আলম
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে গতকাল দুপুরে আসে একটি রোহিঙ্গা পরিবার। নৌকা থেকে মালপত্র নামানোর আগে শিশুসন্তানকে তুলে দেওয়া হচ্ছে মায়ের হাতে l ছবি: আশরাফুল আলম

ত্রাণ বিতরণ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, হুইপ ইকবালুর রহিম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, আইজিপি এম শহীদুল হক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন, শেখ রেহানার পুত্রবধূ সিনিয়র আইএমও কর্মকর্তা পেপী সিদ্দিকসহ স্থানীয় সাংসদ ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।