মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন বিলের সংশোধনী সংসদে

মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণের বাণিজ্যিক ব্যবহার রোধ ও পরিধি বাড়াতে আত্মীয়ের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করে জাতীয় সংসদে ‘মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) বিল, ২০১৭’ বিল উত্থাপন করা হয়েছে।

আজ বুধবার সংসদের বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিলটি উত্থাপন করেন। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

এর আগে বিকেল পাঁচটায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।

বিলে বলা হয়েছে, কোনো হাসপাতাল সরকারের অনুমতি ছাড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন করতে পারবে না। এ আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। তবে সরকারি হাসপাতালের বিশেষায়িত ইউনিটে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের ক্ষেত্রে অনুমতি লাগবে না।

বিদ্যমান আইনে শুধু পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং রক্ত-সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা এই ১২ জন আত্মীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারেন। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ‘নিকট আত্মীয় বলতে পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও রক্তের সম্পর্কিত চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি, আপন চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো-খালাতো ভাই-বোনদের বোঝানো হয়েছে। তাঁরাও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারবেন। তবে তাঁদের বয়স ১৮ বছরের বেশি হতে হবে।

বিলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলতে মানবদেহের কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, অন্ত্র যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চক্ষু, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যেকোনো অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গকে বোঝাবে।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সুস্থ ও স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির চোখ ছাড়া অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিযুক্তির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকলে তিনি নিকটাত্মীয়কে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন ও প্রতিস্থাপনে নিকটাত্মীয় হওয়ার প্রয়োজন হবে না।

বিলে বলা হয়েছে, ‘জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করলে ওই ব্যক্তির ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণার পর আইনানুগ উত্তরাধিকারী যদি লিখিতভাবে অনুমতি দেন, তাহলে সংযোজনের জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিযুক্ত করা যাবে। ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো দাবিদার না থাকলে ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণাকারী হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পালনকারী ব্যক্তি অনুমতি দিতে পারবেন। মেডিসিন বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, নিউরোলজি এবং অ্যানেসথেসিওলজি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার কমপক্ষে তিনজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কোনো ব্যক্তির ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণা করতে পারবেন। তবে ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণাকারী কমিটির কোনো চিকিৎসক বা তাঁর নিকটাত্মীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বা সংযোজন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না।

বিলে বলা হয়েছে, ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তির বয়স দুই বছরের কম অথবা ৬৫ বছরের বেশি হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন বা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম অথবা ৬৫ বছরের বেশি হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না। তবে পুনরুৎপাদনশীল টিস্যুর ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা রক্ত-সম্পর্কিত ভাই বা বোন হলে অথবা চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন বা প্রতিস্থাপনে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

বিলে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যুর আগে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে লিখিত আপত্তি করে থাকেন, তাহলে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না। ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা গ্রহীতা হিসেবে অগ্রাধিকার পাবেন। তবে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে বয়সের এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের কাজ পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ‘নির্ধারিত’ যোগ্যতর ব্যক্তিদের নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করতে হবে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও সংযোজনে সহায়তা দিতে একটি প্রত্যয়ন বোর্ড থাকবে। ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহের অনুমতি প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে ‘ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটি’ থাকবে।

বিলে আত্মীয়ের মিথ্যা তথ্য দেওয়াসহ আইন ভঙ্গের অপরাধে সাজার মেয়াদ কমলেও বাড়ানো হয়েছে জরিমানা। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি নিকটাত্মীয় সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলে বা মিথ্যা তথ্য প্রদানে উৎসাহিত বা প্ররোচিত বা ভীতি প্রদর্শন করলে অনধিক দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। আইনের অন্যান্য বিধান লঙ্ঘন করলে অথবা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। কোনো চিকিৎসক দণ্ডিত হলে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের দেওয়া নিবন্ধন (চিকিৎসা সনদ) বাতিল হবে। এ ছাড়া কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করলে অনুমতি বাতিল ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।