নিঃসঙ্গতায় ওরা কেন সঙ্গী

বয়স্ক মানুষটি ধবধবে এক সাদা বিড়াল নিয়ে এলেন হাসপাতালে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে বিড়াল। চিকিৎসকেরা খুব চেষ্টা করলেন বিড়ালটিকে সারিয়ে তুলতে, কিন্তু কাজ হলো না। খানিক পর হাসপাতালেই বিড়ালটি মারা যায়। প্রিয় বিড়ালটিকে হারিয়ে কাঁদতে লাগলেন বুড়ো মানুষটি। তাঁর এই কান্না দেখে হাসপাতালের একজন প্রাণী চিকিৎসকও অঝোরে কাঁদতে থাকেন।

পশুপাখির প্রতি প্রগাঢ় এই মমতা যাঁর, তিনি মাকসুদুল হাসান হাওলাদার। ঢাকার কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের চিকিৎসক। সপ্তাহের সাত দিনই তাঁকে পাওয়া যায় ওই হাসপাতালে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন প্রাণীর চিকিৎসা করে চলেছেন।
এখনো সেই বৃদ্ধের কান্নার ছবি তাঁর স্মৃতির পর্দায় বারবার ভেসে ওঠে। যখন হাসপাতালে কোনো প্রাণীর মৃত্যু হয়, তখন তাঁর মন কাঁদে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়ায়। প্রাণীর বেদনায় তিনি মর্মাহত হন। প্রাণীর উচ্ছ্বাস তাঁকে আনন্দ দেয়।
কুকুর আর বিড়ালের স্নায়ুতন্ত্র বেশ সংবেদনশীল। মানুষের আবেগ বোঝে কুকুর-বিড়াল। এ জন্যই কুকুর-বিড়াল মানুষের পোষ মানে। বিজাতীয় জীবের সঙ্গে মানুষের এই বন্ধুত্বের অনেক ঘটনা দেখেছেন তিনি।
একবার এক নারী অসুস্থ পোষা বিড়াল নিয়ে তাঁর কক্ষে ঢোকেন। বিড়ালটিকে দেখিয়ে সেই নারী মাকসুদুলকে বলেন, তাঁর বিড়ালটির যদি কিছু হয়, তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন! কিছুদিন আগে আরেকটি বিড়াল নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক অধ্যাপক। ভালো করে বিড়ালটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন, সে ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। বিড়ালটিকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু বিড়ালটি হাসপাতালেই মারা যায়। এরপর সেই অধ্যাপক মাকসুদুলকে বললেন, এই বিড়ালের মৃত্যুর খবর কোনোভাবে তাঁর ছেলেকে জানানো যাবে না। কারণ, বিড়ালটি সঙ্গে তাঁর ছেলের গভীর বন্ধুত্ব। ছেলে যদি বিড়ালের মৃত্যুর খবর জানতে পারে, তবে তিনি পাগাল হয়ে যাবেন। এরপর ছেলেটি আসেন মাকসুদুলের কাছে। তখন মাকসুদুল সেই ছেলেটিকে বলেন, বিড়ালটির উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

হাসপাতালে এক প্রাণীর চিকিৎসা দিচ্ছেন মাকসুদুল হাসান হাওলাদার। ছবি: আসাদুজ্জামান
হাসপাতালে এক প্রাণীর চিকিৎসা দিচ্ছেন মাকসুদুল হাসান হাওলাদার। ছবি: আসাদুজ্জামান

এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। অসুস্থ কুকুর বা বিড়াল নিয়ে এসে মনিব পোষা প্রাণীর জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন। আর পোষা প্রাণীর মৃত্যুতে মনিবের কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য তো তিনি হরহামেশাই দেখছেন।

মাকসুদুল মনে করেন, পোষা প্রাণীর মধ্যে কুকুর আর বিড়ালের স্নায়ুতন্ত্র অনেক উঁচু মানের। এমন অনেক কুকুর-বিড়াল দেখেছেন যে মনিব অসুস্থ হলে তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। মালিকের মৃত্যু হলে তার স্বজনেরা যেভাবে আহাজারি করে, ঠিক তেমনভাবে কুকুর-বিড়ালটিও একইভাবে আহাজারি করে। এমনও হয়েছে—একটি বিড়াল যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তার সঙ্গী বিড়ালটিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতই তীক্ষ্ণ ওদের অনুভূতি।

প্রাণীদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কেন বাড়ছে?

অসুস্থ কুকুরটি কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের ফটকে। ছবি: আসাদুজ্জামান
অসুস্থ কুকুরটি কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের ফটকে। ছবি: আসাদুজ্জামান

এ প্রশ্নের জবাবে মাকসুদুল বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনেক পরিবারে ছেলেমেয়ে, মা-বাবা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে পরিবারের সদস্যসংখ্যা কমছে। চাকরির কারণে ছেলেমেয়েরা দূরে সরে যাচ্ছে। বৃদ্ধ মা-বাবার কোনো সঙ্গী থাকছে না। অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গীও নেই। এসব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অবসর সময়ে এসব মানুষ কুকুর-বিড়ালদের সঙ্গ দিচ্ছে। একধরনের সংযোগ হচ্ছে। এসব প্রাণীর সঙ্গে মানুষ অনুভূতি বিনিময় করছে।

মনিব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, দরজায় কলিং বেল চাপছেন কোনো অতিথি। মনিবের ঘুম ভাঙছে না। ঘরের মধ্যে থাকা কুকুর বা বিড়ালটি মনিবের কাছে যাচ্ছে। ঘুম থেকে ডেকে তুলছে। এভাবে পোষা প্রাণী মানুষের কাছে আসছে। মাকসুদুল বলেন, ‘এসব প্রাণী মানুষকে সঙ্গ দিচ্ছে। মানুষের অনুভূতি বুঝছে। মানুষের কান্নায় কুকুর-বিড়াল কাঁদছে। মানুষের কাছের মানুষ একসময় ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরা ছেড়ে যাচ্ছে না। বিশ্বাসের মর্যাদা রাখছে। এভাবে এরা হয়ে উঠছে মানুষের প্রিয় বন্ধু। প্রিয় সঙ্গী।’