তিনি এখন গর্বিত হকার

সংবাদপত্র বিলি করছেন ইসহাক শরিফ। ছবিটি সম্প্রতি তোলা l সাইয়ান
সংবাদপত্র বিলি করছেন ইসহাক শরিফ। ছবিটি সম্প্রতি তোলা l সাইয়ান

টানা ৩৫ বছর কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নেওয়ার পর এখন তিনি পরিচিত হকার হিসেবে! এই পরিচিতিতে আনন্দ পান তিনি। এক বছর ধরে অবসরপ্রাপ্ত এই কলেজশিক্ষক প্রতিদিন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংবাদপত্র বিলি করেন।

এ নিয়ে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের মধ্যে ছিল তীব্র আপত্তি। বিদ্রূপও করেছেন অনেকে। কিন্তু এই কলেজশিক্ষক সবকিছু তুচ্ছ করে কাজটি করেই চলেছেন। প্রতিদিন আড়াই শর বেশি পত্রিকা বিক্রি করেন তিনি। ইসাহাক শরিফ নামের এই অন্য রকম মানুষটির বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায়।

এত কাজ থাকতে কেন এমন কাজ বেছে নিলেন? প্রশ্ন করতেই মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘কোনো কাজেই অগৌরব নেই, কাজের মধ্যে যদি আনন্দ পাওয়া যায়, সততা থাকে, সেটাই হলো প্রকৃত কাজ।’

আর্থিক অসচ্ছলতা নেই, তবু কেন হকারি করছেন? বললেন, ‘দেখুন, অর্থের জন্য এটা করি তা নয়। এখানে বড় ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ হিসেবে আমার যে দায়িত্ব তা কতটুক করতে পারছি আমি। পত্রিকা বিলি করে যে টাকা আয় হয় তার বেশির ভাগই গ্রাহকদের বকেয়া বাবদ কেটে দিই। তবু তো কিছু মানুষ সংবাদপত্র পড়ল। সংবাদপত্র হলো সমাজের আয়না। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিদিনকার হালনাগাদ তথ্য মানুষের জানা উচিত। এতে মানসিক সুস্থতা আসে, সামাজিক স্থিরতা আসে। জ্ঞান শুধু বইয়ের মধ্যে নয়, জ্ঞান ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে। এ জন্যই দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দিই।’

ইসাহাক শরিফের মতে, ‘পাঠে মনোযোগী হলে নবীনেরা বিভ্রান্ত হবে না, মাদক ও অপরাধ থেকে দূরে থাকবে। পত্রিকায় ভালো-মন্দ সব খবর আছে। এতে ভালো-মন্দের তফাতটা বুঝতে পারে মানুষ। আমাদের সমাজ ও চিন্তাকে সুস্থির, সাবলীল ও ইতিবাচক করতে হলে জ্ঞান ও তথ্যের বিকল্প নেই।’

বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নে ১৯৪৯ সালে জন্ম ইসাহাক শরিফের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর করার পর বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া গ্রামে তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। কলেজের পাশেই তাঁর মায়ের নামে রয়েছে জামেনা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

ইসাহাক শরিফ দুই ছেলেমেয়ের বাবা। দুজনই উচ্চশিক্ষিত, চাকরিরত। স্ত্রী হাফিজা বেগম আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরি করছেন।

কথা প্রসঙ্গে বললেন, অবসর গ্রহণের পর বাকি জীবনে কিছু একটা করা দরকার। তা ছাড়া প্রত্যেক মানুষেরই একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। ঠিক করলেন প্রত্যন্ত এলাকায় পত্রিকা বিলির কাজ করবেন তিনি। এতে যেমন নবীন-প্রবীণ সব শ্রেণির মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে, তেমনি ঘাম ঝরিয়ে নিজেকে সুস্থ রাখা যাবে। কখনো যানবাহনে করে, কখনো হেঁটে তিনি প্রতিদিন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পত্রিকা হাতে ছুটে বেড়ান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি এই কাজ করেন।

ইসাহাক শরিফের স্ত্রী হাফিজা বেগম এখন মানিয়ে নিয়েছেন স্বামীর এ কাজ। তিনি বলেন, ‘অবসর সময়ে তিনি (ইসাহাক শরিফ) এখন মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি এটা করছেন। অবসর সময়ে তিনি এটা করে শান্তি পাচ্ছেন—এটাই আনন্দের কথা।’

দেহেরগতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, বছরখানেক আগে স্যারের বগলে পত্রিকার বান্ডিল দেখে বিস্মিত হই। তাঁকে এ কাজ করতে বারণ করি। কিন্তু তিনি শোনেননি। এখন বুঝি আমরাই ভুলের মধ্যে ছিলাম। এখন স্যারকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। এমন সাদামনের মানুষেরা আসলেই দেশের সম্পদ।’

ইসাহাক শরিফ বলেন, ‘একটি আকাঙ্ক্ষা আছে আমার। সেটা হলো, একটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার করা। একটি যানবাহনে টেবিল-চেয়ার, বই-সংবাদপত্র থাকবে। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে এই পাঠাগার জ্ঞান বিলাবে। এ জন্য আমার সচ্ছল আত্মীয়স্বজনের কাছে সহায়তা চাইব। তাঁরা সহায়তা না দিলে পথে নামব। এটাই এখন আমার বাকি জীবনের স্বপ্ন।’