অস্ত্রের উৎস ও গন্তব্য জানতে তৎপরতা নেই পুলিশের

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় পূর্বাচলের খাল থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেখছেন পুলিশের কর্মকর্তারা l ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় পূর্বাচলের খাল থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেখছেন পুলিশের কর্মকর্তারা l ফাইল ছবি

এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর দুই প্রান্ত থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এর মধ্যে রকেট লঞ্চার যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিস্ফোরক জেল ও আন্তযোগাযোগের বিভিন্ন সরঞ্জাম। তবে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের উৎস বা গন্তব্য খুঁজে বের করার কোনো তৎপরতা নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

গত বছরের ১৮, ১৯ ও ২৫ জুন তুরাগ থানাধীন মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধসংলগ্ন (বৌদ্ধমন্দিরের পাশে) দিয়াবাড়ি খাল থেকে তিন দফায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। এর প্রায় এক বছরের মাথায় গত ২ ও ৩ জুন পুলিশ রূপগঞ্জ এলাকা থেকে কয়েক দফায় আবারও অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

রূপগঞ্জ থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধারের দিনই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কর্মকর্তারা জানান, উত্তরার অস্ত্রগুলোর সঙ্গে রূপগঞ্জের অস্ত্রের যোগসূত্র রয়েছে। একই ব্যক্তিরা অস্ত্রগুলো সেখানে ফেলে রেখে গেছেন বলে তাঁদের ধারণা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী। বড় কোনো উদ্দেশ্যে কোনো গোষ্ঠী এসব সংগ্রহ করেছিল। এরপর যখন অস্ত্রগুলো তাদের কাছ বোঝা মনে হয়েছে, তখন ফেলে দিয়েছে। তবে এত অস্ত্র কীভাবে ঢাকায় ঢুকল, তা তদন্ত করে বের করতে হবে।

উত্তরার অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার নেই। তবে রূপগঞ্জের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ওই এলাকার মো. শরীফ খান, মো. শাহীন হোসেন, মো. রাসেল, শান্ত ও মো. মুরাদ মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে সাব্বির নামে আরেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর হৃদয় নামে আরেক আসামি কাতারে রয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শরীফ খান একজন মাদক ব্যবসায়ী। তিনি একসময় র‍্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন।

২ জুন রূপগঞ্জের গুতিয়াব এলাকার ব্লু-সিটি হাউজিং প্রকল্প থেকে দুটি এসএমজি এবং একই দিন রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহরের ৫ নম্বর সেক্টরের পশ্চিম-উত্তর সীমানাসংলগ্ন ৩০৪ নম্বর রোডের উত্তর পাশে লেকের দক্ষিণ পাড়ে পানির নিচ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এর পরদিন রূপগঞ্জের বাসুন্দা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এসএমজি উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে গুতিয়াব এলাকার একটি কবরস্থান থেকে পিস্তলের গুলি উদ্ধার করে পুলিশ।

রূপগঞ্জে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় গত ৩ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দার সে সময়কার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক মো. মাহমুদুল ইসলাম রূপগঞ্জ থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করেন। মাহমুদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার প্রত্যেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে
একটি কবরস্থান থেকে আরও ৩১৫টি গুলি উদ্ধার এবং আরেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উত্তরা ও রূপগঞ্জ দুটি ক্ষেত্রেই অস্ত্রগুলো লেকে ফেলা হয়। উত্তরার অস্ত্রগুলো ব্যাগে করে লেকে ফেলার সময়ই পুলিশের এক কনস্টেবল তা দেখে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো উদ্ধার করা হয়। কিন্তু রূপগঞ্জের অস্ত্রগুলো লেকে ফেলা হলেও সেগুলো ঘটনাক্রমে ওই এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছে যায়।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্বাচল উপশহরের অস্ত্রগুলো কে বা কারা ওই লেকে ফেলে যায়। এরপর কোনো একভাবে এর সন্ধান প্রথমে জানতে পারেন হৃদয়। গত জানুয়ারিতে কাতারে যাওয়ার আগে তিনি পাঁচটি অস্ত্র তাঁর চাচাতো ভাই মুরাদের কাছে এবং তিনটি অস্ত্র তিনজনকে দিয়ে যান। এর মধ্যে একটি অস্ত্র ইয়াবার বিনিময়ে কেনেন মাদক ব্যবসায়ী শরীফ, যার সূত্র ধরে পুরো ঘটনাটি উদ্‌ঘাটিত হয়।

লেকের পাড়ে গিয়ে হৃদয় যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে তাঁর নানা আমির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর থেকে হৃদয়ের মা-বাবা এখান থেকে চলে যান।

সিআইডি থেকে মামলাটি তদন্ত করছেন ঢাকা মেট্রোর সিনিয়র এএসপি মো. এহসান উদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক আসামি হৃদয়কে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ইতিমধ্যে দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন তাঁরা।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্র রাখা এবং এর অবস্থান থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ির অস্ত্র ও এই অস্ত্রগুলো একই সূত্রের বলে তাঁরা মনে করছেন।

উত্তরার অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তুরাগ থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, অস্ত্রগুলো কে বা কারা ফেলে রেখে গেছে তা জানা যায়নি। উৎস নির্ণয় করতে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এগুলোর প্রতিবেদন এখনো আসেনি। তাদের আবারও তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং সিআইডির সাবেক এএসপি ফজলুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যালেস্টিক বা মাইক্রোঅ্যানালাইসিস দিয়ে অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে অস্ত্রের ধরন ও ক্ষমতা বের করা সম্ভব। তিনি বলেন, ছিঁচকে চোর-ডাকাত বা মাদক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অস্ত্রের উৎস, গন্তব্য—এসব বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো উচ্চপর্যায়ের তদন্ত। তাঁর বিশ্বাস, একজন তদন্ত কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারলে এর রহস্য বের করতে পারবেন।