শরীয়তপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর

পদ্মা নদী কয়েক হাত দূরে। ভাঙনের আতঙ্কে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে শেষ সম্বলসহ অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরজুজিরা গ্রামের কয়েকটি পরিবার। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি l প্রথম আলো
পদ্মা নদী কয়েক হাত দূরে। ভাঙনের আতঙ্কে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে শেষ সম্বলসহ অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরজুজিরা গ্রামের কয়েকটি পরিবার। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি l প্রথম আলো

শরীয়তপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ভিটেমাটি, বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা। ঘটছে প্রাণহানিও। ভাঙনে গত ১৫ দিনে নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলায় গৃহহীন হয়েছে ৭৫০ পরিবার। নদী থেকে আর মাত্র ১৫০ মিটার দূরত্বে রয়েছে ৫০ শয্যার নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি।

গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ বছর পদ্মার ভাঙনে জেলায় ৩ হাজার ৭৪০ পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। গত পাঁচ বছরে গৃহহীন হয়ে পড়েছে ২১ হাজার পরিবার। ভাঙনের কারণে প্রাণহানি ঘটেছে অনেক লোকের।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সোমবার ভোররাতে পদ্মার ভাঙনে নড়িয়ার ওয়াপদা লঞ্চঘাটের পন্টুন বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনটি লঞ্চ ডুবে যায়। এতে লঞ্চে থাকা ২১ ব্যক্তি নিখোঁজ হন। এর মধ্যে গতকাল নড়িয়ার সুরেশ্বর এলাকা থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ২০১৩ সালে ভাঙনের কারণে সাধুর বাজার ঘাটে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। তখন লঞ্চের ছয়জন কর্মী নিখোঁজ হন। গত বছর জাজিরার কলমিরচর এলাকায় ভাঙনে মাটি ধসে নিহত হন তিন ব্যক্তি।

গতকাল উদ্ধার হওয়া লাশ দুটির মধ্যে এক যুবকের পরিচয় জানা যায়নি। অপর লাশটি নড়িয়ার লোনসিং এলাকার পারভীন আক্তারের। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভাঙনের কারণে সব হারালাম। নদীর স্রোতে পন্টুন ধসে লঞ্চ ডুবে যায়। আমি তীরে আসতে পারলেও স্ত্রী-সন্তান ও শাশুড়িকে খুঁজে পাইনি।’

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাজিরা ও নড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা পদ্মাবিধৌত। প্রতি বর্ষায়ই এ দুটি উপজেলায় ভাঙন দেখা দেয়। এ বছরও জাজিরার পালেরচর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভাঙন হচ্ছে নড়িয়ার মোক্তারের চর, কেদারপুর, চরআত্রা, নওপাড়া ও ঘড়িসার এবং জাজিরার কুণ্ডের চর, বড়কান্দি ও জাজিরা ইউনিয়নে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনকবলিত গ্রামের মানুষ বসতবাড়ির আসবাব সরিয়ে নিচ্ছে। কালু ব্যাপারী কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় তলাবিশিষ্ট ভবনটি ও শেহের আলী মাদবর কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পাকা ভবন ভেঙে নেওয়া হচ্ছে।

কালু ব্যাপারী কান্দি গ্রামের মনির ব্যাপারী বলেন, ‘পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ফসলি জমি, বসতবাড়ি সব বিলীন হয়েছে। এখন কোথায় আশ্রয় নেব আল্লাহই জানেন।’

নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ বাজারে অবস্থিত নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি নদী থেকে ১৫০ মিটার দূরে রয়েছে। সেটি এখন ভাঙনের ঝুঁকিতে। এ এলাকায় নদী ৫০০ থেকে ৮০০ মিটার পর্যন্ত ভেতরে ঢুকেছে।

জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মুনীর আহমদ খান বলেন, ভাঙনের যে গতি তাতে যেকোনো সময় কমপ্লেক্সটি পদ্মায় বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি স্থানীয় সাংসদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বিভাগীয় পরিচালককে জানানো হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাজিরার দুর্গারঘাট থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এ বছর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাপক ভাঙনের আশঙ্কা করা হয়। এ নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একটি গবেষণার তথ্য স্থানীয় অধিবাসী ও প্রশাসনকে জানায় সংস্থাটি। এ গবেষণায় ব্র্যাককে কারিগরি সহায়তা দেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস। তারা গত জুনে ওই সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকায় জনগণকে সতর্ক থাকার জন্য লাল ও হলুদ পতাকা টাঙিয়ে দেয়। এই এলাকায়ই এখন ভাঙন চলছে।

জাজিরার কুণ্ডের চর কালু ব্যাপারী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. সুরুজ মিয়া বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটি গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি চারবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। এখন পাশের নড়িয়ার মোক্তারের চর ইউনিয়ন পরিষদের ভবন ও মাঠে পাঠদান চালাচ্ছি।’

জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত নড়িয়া ও জাজিরায় পদ্মার ভাঙনে ২০ হাজার ৮৯০ পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এর মধ্যে এ বছর গৃহহীন হয়েছে ৩ হাজার ৮৯০ পরিবার। পাঁচ বছরে ফসলি জমি বিলীন হয়েছে ছয় হাজার হেক্টর। নদীগর্ভে চলে গেছে ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬টি উচ্চবিদ্যালয়ের ভবনসহ সরকারি-বেসরকারি অনেক স্থাপনা। জাজিরার কলমিরচর, দুর্গারঘাট, পালেরচর ও কায়ুম খাঁর বাজার এবং নড়িয়ার বাঁশতলা, চণ্ডীপুর ও ওয়াপদা বাজার চলে গেছে নদীতে। শুধু সুরেশ্বর বাজারেই বিলীন হয়েছে দুই শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে পাউবোর শরীয়তপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, ‘পদ্মার ভাঙন রোধে গত পাঁচ বছরে জাজিরা ও নড়িয়ায় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে জাজিরার কুণ্ডের চর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও চর খনন করার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশন থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার অবস্থায় রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ১ হাজার ২৮০ কোটি টাকার এ প্রকল্প অনুমোদন হলে আগামী বর্ষার আগে এ এলাকায় ভাঙন রোধ করা যাবে।’

জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, ‘পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ দুশ্চিন্তায় আছে। ভাঙন রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জানানো হচ্ছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাদ্যসহায়তা, নগদ অর্থ ও গৃহনির্মাণের সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। তাদের খাসজমিও দেওয়া হবে।’