ডিম নিয়ে ডামাডোল

কেউ বালতি, কেউ ডিমের খাঁচি কেউ বা কাগজের কার্টন নিয়ে এসেছেন। এই দৃশ্য রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণের। কারণ, সেখানে তিন টাকায় ডিম বিক্রি হচ্ছে। আর এই দামে ডিম কিনতে সকাল থেকে রাজধানীর নানা বয়সী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। তবে ডিম জুটেছে গুটিকয়েকের কপালে। ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে পড়েছে ডিম বিতরণের অস্থায়ী মঞ্চ। ডিম কিনতে না পেরে ক্ষুব্ধ লোকজন বিক্ষোভ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে।

১৩ অক্টোবর শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবস। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এই আয়োজন করে।

ডিম বিক্রি করতে তৈরি করা হয় এই অস্থায়ী মঞ্চ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ডিম বিক্রি করতে তৈরি করা হয় এই অস্থায়ী মঞ্চ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সকাল দশটা থেকে ডিম দেওয়ার কথা ছিল। তবে সকাল নয়টায় বিক্রি শুরু হয়। সর্বোচ্চ ৯০টি করে ডিম দেওয়ার কথা থাকলেও মানুষের চাপ দেখে আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্যাকেট করা হয় ২০টি করে। হুড়োহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কিতে ডিম দেওয়া মিনিট দু-একের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের হুড়োহুড়িতে আয়োজকেরা প্যান্ডেল থেকে ডিম দেওয়া বন্ধ করে দেন। ধাক্কাধাক্কিতে একপর্যায়ে ডিম বিতরণের জন্য তৈরি অস্থায়ী মঞ্চ ভেঙে পড়ে। বেশ কয়েক খাঁচি ডিম ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে ডিমের ওপরে গিয়ে পড়েন। রোদে দাঁড়িয়ে আর ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন নারী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

হুড়োহুড়ির মাঝে দু-একজনকে ডিম পেতে দেখা যায়। তবে অধিকাংশই ডিম পাননি।

এক লোকের হাতে তিনটা ডিম দেখা গেল। জিজ্ঞেস করতেই সে হেসে বলল, ‘ভাই আমি পাঁচটায় এসেছি, ডিম পাইনি কৌশলে চুরি করে নিছি।’

ডিম না পেয়ে সকাল নয়টা থেকেই মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। অনেকে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ পরপরই শোরগোলের আওয়াজ করছিল মানুষ।

স্বেচ্ছাসেবীরা মানুষকে বোঝাতে হিমশিম খান। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে তেজগাঁও থানার পুলিশ যোগ দেয়। তারা কয়েকবার লাটিচার্জ করে। তারপরও মানুষ ডিম নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে।

ডিম না পেয়ে মানুষ ‘আর কোনো দাবি নাই, ডিম চাই বিচার চাই’, ‘ভুয়া ভুয়া’, ‘ডিম চোর, ডিম চোর’, ‘ডিম চাই ডিম চাই’-স্লোগানে বিক্ষোভ করতে থাকে।

ডিম কিনতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ডিম কিনতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ৩৩ বছর বয়সী লিটন হালদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কষ্ট লাগছে ডিম পেলাম না। যে কষ্ট করছি, এর চেয়ে ডিম দোকান থেকে কিনলেও শান্তি পেতাম। মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই এ আয়োজন। যেভাবে প্রচার করা হয়েছে তার কিছুই নেই। লাঠিপেটা করে কিছু হবে?’

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সারোয়ার মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত হাজার হাজার লোককে কেন এত কষ্ট দিল। আমরা এর বিচার চাই, কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। কেন মিডিয়াতে ঢোল পিটিয়ে ডিমের কথা বলা হলো? কেউ ডিম পায় নাই এখানে। এমন হয়রানি করার কী দরকার?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্‌দীন হলের শিক্ষার্থী মুরসালিন আহমেদ সকালে খামারবাড়ি আসেন ডিম নিতে। তাঁরা একসঙ্গে ৪৫ জন এসেছেন। মুরসালিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাচেলর লাইফে ডিমই তো সব।

আয়োজকদের পক্ষ থেকে পরে মাইকে বলা হয়, ডিম দিবস উপলক্ষে ভোক্তাসাধারণের যে উদ্দীপনা তা কল্পনার বাইরে। শিগগিরই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্পটে একই দামে ডিম বিক্রি হবে।

ডিম দিবস উপলক্ষে সুলভ মূল্যে ডিম বিক্রির আয়োজক বিপিআইসিসির সভাপতি মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি যেমন ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ভিড় হয়েছে। পুলিশ এবং আমাদের ভলান্টিয়ারি সার্ভিস ঠিক ছিল। যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ হয়েছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত। আমরা আশা করি, বাকি সারা দিনে আমরা সামাল দিব। ১ লাখ ডিম আমাদের হাতে ছিল। আমরা জানি না কত ডিম বিতরণ হয়েছে। আমরা এটা ব্যর্থতা মনে করি না, এটা আমাদের সফলতা। পরিস্থিতির কারণে আমরা ডিম বিক্রি বন্ধ করেছি। এটাতে প্রমাণ হয় জনগণ সাড়া দিয়েছে।’

গুলশান নিবাসী গৃহিণী তানজিলা হক ভোর ছয়টায় খামারবাড়ি এসেছিলেন। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে ডিম বিক্রির কথা জেনেছেন। তানজিলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা ডিমও পেলাম না। এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। বলেছে ডিম নেই। বিক্রি হয়ে গেছে, দেওয়া যাবে না। তাহলে কেন মিডিয়াতে বলা হলো, প্রচার করা হলো, মোবাইলে মেসেজ দিলো।’

টঙ্গী থেকে আসা মেসবাহ উর রহমান নামের এক চাকরিজীবী বললেন, ‘ব্যবস্থাপনা পুরাই খারাপ। সবাই লাইন ভেঙেছে। ৯০ টি ডিম দেওয়ার কথা। পরে শুনি ৩০টি করে দেবে। শেষে শুনলাম ২০ টা করে দিবে। কেউ ডিম পায়নি। শুরুতে ৩ জনকে ডিম পেতে দেখেছি।’

শুক্রবার ছুটির দিন বলে ধানমন্ডি-১৫ থেকে এসেছিলেন আরেক গৃহিণী ফারহানা নাসরিন। তিনি ডিম কিনতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় ফারহানা প্রথম আলোকে বললেন, ‘বাসার সবাই ডিম খায়। বাজারে তো ডিমের হালি ৩১ টাকা। এখানে ১২ টাকা করে দিবে বলে আসা হয়েছে। ধাক্কাধাক্কি ও অব্যবস্থাপনা দেখে খুবই হতাশ লাগলো। তাই ফিরে যাচ্ছি।’

যাত্রাবাড়ী নিবাসী রাজিব আহমেদ বললেন, ‘এটা তো জনগণের সঙ্গে পুরো প্রতারণা। এভাবে ডেকে এনে আমাদের অপমানের দরকার কী? ডিম তো দিলও না, আবার লাঠিপেটা করল পুলিশ। এ কেমন বিচার?’

আরও পড়ুন...