মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ নয়: ইইউ

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং। ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং। ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ ছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় আমন্ত্রণ না জানানোসহ আটটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ কাউন্সিল। লুক্সেমবার্গে এক সভায় আজ সোমবার এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রথম সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে—রাখাইন রাজ্যে মানবিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবস্থা শোচনীয়। সেখানে ধারাবাহিকভাবে গোলাগুলি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সহিংসতা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এর তাৎক্ষণিক অবসান হওয়া প্রয়োজন। সহিংসতা ও আতঙ্কের কারণে পাঁচ লাখের বেশি লোক, যাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যখন বিপুলসংখ্যক মানুষ দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়, তখন বুঝতে হবে সেখানে সংখ্যালঘুদের বের করে দেওয়ার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরতে পারে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক সাহায্য দেওয়ার জন্য ও গণমাধ্যমের রাখাইনে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিধি-নিষেধ আছে। এর ফলে চাহিদার সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সব ধরনের সহিংসতা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইইউ। সংস্থাটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযান বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছে। একই সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলার জন্য সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছে ইইউ। এ ছাড়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে দরকারি পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘ, আইসিআরসিসহ সব আন্তর্জাতিক বেসরকারির উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে শর্তহীন পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে হবে। যারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তাদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে আনতে বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এরই মধ্যে ধাপে ধাপে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে মানবিক সহায়তা দেওয়ার কাজ করছে ইইউ এবং এর পরিধি রাখাইন রাজ্যেও বিস্তৃত করার জন্যও সংস্থাটি প্রস্তুত রয়েছে।

তৃতীয় সিদ্ধান্তে আছে—২০১৬ সালের জুন মাসে মিয়ানমারের বিষয়ে নেওয়া কৌশলের ক্ষেত্রে ইইউ ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো অটল আছে। মূলত দেশটির গণতান্ত্রিক উত্তরণ, শান্তি, জাতীয় সমন্বয় ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়গুলো সমর্থন করে ইইউ। উপদেষ্টা কমিশন রাখাইন রাজ্যের ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারকে সমর্থন করতে প্রস্তুত ইইউ। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমারের সরকার আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানায় ইইউ।

চতুর্থ সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইইউ বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। তাঁর এ বক্তব্যকে ইইউ স্বাগত জানায়। শিশুদের ওপর নিষ্ঠুর হামলাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক অভিযোগগুলোর বিশদ তদন্ত করা উচিত। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের স্বাধীন আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী মিশনকে মিয়ানমারের পূর্ণ সহযোগিতা করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছে ইইউ। আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী মিশনকে অবিলম্বে দেশটিতে নিরাপদে ঢুকতে দিতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল সম্প্রতি অনুসন্ধানী মিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানায় ইইউ।

বর্তমান সংকটের সমাধানের জন্য বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে শরণার্থীদের নিজেদের বাসস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে, ইইউ তার প্রশংসা করেছে।

নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সামঞ্জস্যবিহীন বলপ্রয়োগের ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের কোনো প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় আমন্ত্রণের বিষয়টি বাতিল করা হবে। অন্তর্বর্তী নিপীড়নে ব্যবহার করা যায়, এমন অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামের ওপর বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে ইইউ। পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বাড়তি পদক্ষেপও নিতে পারে কাউন্সিল।

কাচি ও শান রাজ্যের মানুষের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েও ইইউ উদ্বিগ্ন। সেখানেও মানবিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং ওই সব এলাকায় প্রবেশাধিকার দিতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইইউ।

সর্বশেষ সিদ্ধান্তে ইইউ বলছে, ২০-২১ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় আসেমের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইইউ মিয়ানমারের সরকার ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করতে চায়।