বন্যা ও আশার সেতু

১৫০ হাত লম্বা সেই বাঁশের সেতু। ছবি: মঈনুল ইসলাম
১৫০ হাত লম্বা সেই বাঁশের সেতু। ছবি: মঈনুল ইসলাম

বেলা তখন পড়ে এসেছে। লন্ডভন্ড বাঁশঝাড়ের তলায় জমে থাকা আবছায়া গাঢ় অন্ধকার হয়ে উঠছে। চারপাশে পথ বলে কিছু নেই। বালু মাটি উথালপাতাল হয়ে আছে ট্রাক্টরে চাষ দেওয়া ধানখেতের মতো। কোথাও কোথাও ডোবার মতো গর্ত। তাতে পানি জমে আছে। উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছগাছালি। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি। তার ভেতর দিয়েই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন কুড়িগ্রাম ডিগ্রি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান শ্রেণির শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম। এই গ্রামের নাম ‘চতুর্ভুজ’। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার এই গ্রামটির এমন জ্যামিতিক নামকরণের উৎস কী, তা জানার একটু কৌতূহল জাগলেও বিশদ জানার মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না। গত ১৯ আগস্ট সন্ধ্যার আগে আগে আমরা এসে পৌঁছাই এই প্রত্যন্ত গ্রামে।

কুড়িগ্রামের বন্যার খবর সংগ্রহ করতে আমি এখানে আসি ১৬ আগস্ট। জেলা প্রতিনিধি শফি খান আর রংপুর থেকে আসা আমাদের আলোকচিত্র সাংবাদিক মঈনুল ইসলামসহ আমরা জেলার উপজেলাগুলো ঘুরে ঘুরে বন্যা পরিস্থিতির খবর সংগ্রহ করছিলাম। সব কটি উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়েছিল। আর পানির প্রবল তোড়ে গ্রামের পর গ্রাম, সড়ক, বাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। চতুর্ভুজ এমনি একটি বিধ্বস্ত গ্রাম।

খানিকটা এগোনোর পরই কান্নার শব্দ কানে এল। আমরা উপড়ে পড়া বাঁশঝাড় ও গাছগাছালির ভেতর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া এক টিনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াই। ঘরের সামনেই বসে কাঁদছিল নয়-দশ বছরের লাবণী। তাদের টিনের দেয়াল, টিনের ছাউনির ঘরটি বন্যার তোড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। পাশেই তাদের দাদি মালেকা বেওয়ার ঘর। এটা–ওটা বলে নাতনির কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু লাবণীর কেবলই তার মা ফাতেমা বেগমের কথা মনে পড়ছিল, আর কান্না পাচ্ছিল খুব। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বলছিল, ‘মায়ে কইল তোরা যা, মুই চাউলের টোপলাখান ধরি আইসম।’ এই ছিল মায়ের সঙ্গে লাবণীর শেষ কথা।

গত ১২ অক্টোবর মাঝরাতে পানির তোড় এসেছিল প্রবলভাবে। ঘুম থেকে জেগে সবাই বাঁধের দিকে দৌড়াতে থাকেন। যাঁরাই একটু পিছিয়ে পড়েছেন বা সামান্য দেরি করেছেন, তাঁরা আর পৌঁছতে পারেননি। ভেসে গেছেন প্রবল তোড়ে।

লাবণীরা দুই ভাইবোন। সে পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে, আর বড় ভাই রাসেল পঞ্চম শ্রেণিতে। তার বাবা লোকমান কৃষিকাজ করেন। মাইকের শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। সবাইকে বাঁধের দিকে যেতে বলা হচ্ছিল। বাবা ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হন। মা তাদের বলেছিলেন বাবার সঙ্গে দৌড় দিতে। তিনি চেষ্টা করছিলেন ঘরে থাকা কিছু চাল সঙ্গে নিতে। ফলে তাঁর একটু দেরি হয়ে যায়। এটুকু কালক্ষেপণই তাঁর জীবনের কাল হয়ে ওঠে। বাঁধের কাছে আসার আগেই সড়কটি পানির তোড়ে ধসে পড়ে। ফাতেমা ভেসে যান। পরদিন দুপুর নাগাদ গ্রামের ছেলেরা নদীর ভেতরে উপড়ে পড়া গাছের শেকড়ের সঙ্গে আটকে থাকা ফাতেমার মৃতদেহ উদ্ধার করেন।

এই গ্রামে রিফাত নামের সাত বছরের এক শিশুরও মৃত্যু হয়েছিল। সে ছুটছিল দাদি মঞ্জিলার হাত ধরে। একটা সময় পানির তোড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা। দাদিকে উদ্ধারকারী তরুণেরা তুলে এনেছিলেন, কিন্তু রিফাতকে শেষ পর্যন্ত আর পাওয়াই যায়নি।

এই উদ্ধারকারী তরুণদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কাজে নেমে পড়ার ফলেই সেদিন প্রাণহানি অনেক কমেছিল। এই তরুণদের নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের সেই পথপ্রদর্শক রাশেদুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবু মূসা, জয়নালসহ গ্রামের আরও অনেকে। রাশেদুল আমাদের জানিয়েছিলেন, (১২ অক্টোবর) রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে হুমহুম শব্দে প্রচণ্ড গর্জন হচ্ছিল। মূল ধরলা নদী তাদের ছিনাই ইউনিয়নের চতুর্ভুজ, কালুয়া, সাতকালুয়া, জয়কুমার পাশাপাশি লাগোয়া এই গ্রামগুলো থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। পানির শব্দে রাশেদুলের ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ংকর কোনো পরিস্থিতি ঘটতে যাচ্ছে এই আশঙ্কা করে তিনি পাশের কয়েক বাড়ির লোকদের ডেকে তোলেন। কয়েক বন্ধুকে নিয়ে চলে যান বাজারের মাইকের দোকানে। সেখান থেকে তাঁরা মাইকে লোকদের ডাকতে থাকেন। কোনো কিছু না নিয়ে সবাইকে দ্রুত বাঁধে এসে ওঠার কথা বলছিলেন তাঁরা। যাঁরা উঠতে পারবেন না তাঁদের বড় কোনো গাছ বা বাড়ির চালে উঠতে বলছিলেন। তবে পানির তোড় এত ভয়াবহ শক্তিতে আঘাত করবে, সেট তাঁদের কল্পনায়ও ছিল না। মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে পানির তোড় সব তছনছ করে দিয়ে ধীর ধীরে শান্ত হয়ে পড়ে। এরপর তাঁরা দ্রুত গ্রামের নৌকাগুলো নিয়ে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ভেসে যাওয়া লোকদের উদ্ধারে নদীতে নেমে পড়েন। নদীর প্রায় তিন মাইল এলাকা পর্যন্ত সন্ধান করে তাঁরা ওই গ্রামগুলোর প্রায় ৮০-৮৫ জনকে পানি থেকে তুলে এনেছিলেন। তাঁদের মধ্যে নারী আর শিশুই ছিল বেশি। গাছের শেকড়ে আটকে যাওয়ার কারণেই ফাতেমা বেগমকে উদ্ধার করা যায়নি। আর পাওয়া যায়নি রিফাতকে। এত বড় বিপর্যয়ের মধ্যেও প্রয়োজনীয় কাজটি দ্রুত ও সম্মিলিতভাবে করার ফলেই প্রাণহানি কমেছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের জানিয়েছিলেন।

চতুর্ভুজের তরুণদের এই উদ্যোগ আরও অসাধারণ মনে হয়েছিল আরেকটি কারণে। ধরলার পানি যেদিক দিয়ে ছুটেছিল, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে গভীর খালের মতো নতুন গতিধারা। তার সামনে পড়েছিল গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের পাকা বাড়ি, সেটি বিধ্বস্ত। বাঁধের মতোই উঁচু পিচঢালা সড়কটিতে গভীর খাদ। প্রায় ১৫০ হাত দীর্ঘ ওই খাদ পেরিয়ে যাতায়াত করার জন্য আপাতত নৌকা চলছে। তবে সেখানে সেতু তৈরির কোনো বিকল্প নেই। কবে সরকারি সাহায্য আসবে, আর কবে সেতু হবে সেই অপেক্ষায় না থেকে তাঁরা নিজেরাই কাজ চালিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।

আমরা দেখালাম প্রায় ১৫০ হাত লম্বা একটি বাঁশের সেতু তৈরি করেছেন তাঁরা। নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আবদুল খালেক নামের এক তরুণ জানালেন, ২৫ জোড়া ড্রামের ওপর বাঁশের পাটাতন তৈরি করে এই সেতু তৈরি করা হচ্ছে। গ্রামের লোকেই বাঁশ আর টাকা দিয়েছেন, যাঁর যা সামর্থ্য। ড্রাম দিয়েছেন উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান কফিলউদ্দিন। এই সেতু সড়কের ভাঙা অংশে জুড়ে দিতে হয়তো সেই রাত পেরিয়ে যাবে। আমরা নৌকাতেই খাদ পার হলাম। চারপাশের ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে, মা মরা শিশুটির কান্নার শব্দ পিছু ফেলে ফিরে যেতে যেতে মনে হলো প্রকৃতির শক্তি যতই প্রবল প্রচণ্ড হোক, এই মানুষগুলো কিছুতেই দমবে না। সব বাধা–বিপত্তিকে ছাপিয়ে অব্যাহত রাখবে জীবনের আবাদ। রচনা করবে আশার বীজতলা।