সবুজ রাঙামাটি যেদিন ধূসর হয়েছিল

পাহাড়ধসে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিকে হারিয়ে দিশেহারা এক নারী। ছবি: সৌরভ দাস
পাহাড়ধসে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিকে হারিয়ে দিশেহারা এক নারী। ছবি: সৌরভ দাস

১৩ জুন। দিনভর বিরামহীন বৃষ্টি। বিকেলের দিকে বৃষ্টির দাপট আরও বাড়ল। সন্ধ্যা নামতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে পাহাড়ধসের খবর আসতে শুরু করল। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ ও রাঙামাটির দু–একটি স্থানে পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। যতই সময় গড়াল, ততই বাড়তে লাগল ধস ও মৃত্যুর সংখ্যা। সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের খবর আসতে শুরু করল রাঙামাটি থেকে। ১৩ জুন রাত পর্যন্ত রাঙামাটিতে চার সেনাসদস্যসহ ৯৬ জনের মৃত্যুর খবর এল।

বিষয়টি ভাবিয়ে তুলল অফিসের সবাইকে। কারণ, এর আগে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ধসের এত বড় ঘটনা ঘটেনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পালসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে পাহাড়ধসের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠিয়ে দিলাম ঢাকায়।

ঠিক হলো, পরদিন অর্থাৎ ১৪ জুন সকাল সকাল রাঙামাটির দিকে রওনা হবো। কিন্তু খবর আসতে লাগল, রাঙামাটির সঙ্গে পুরো দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। কীভাবে যাব, চিন্তায় পড়ে গেলাম।

এর মধ্যে রাতে অন্যান্য গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। তাঁরা কীভাবে যাবেন, তার খোঁজখবর নিলাম। যোগাযোগ করলাম চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। আগেই জেনেছি, রাঙামাটির অবস্থা ভয়াবহ। উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য চট্টগ্রাম থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পরদিন রাঙামাটি যাবেন। জসিম উদ্দিন পরদিন ভোরে রওনা হবেন বলে জানালেন। তবে কীভাবে যাবেন, তা–ও তিনি জানাতে পারলেন না।

১৪ জুন সকাল সাতটায় ফোন করলাম সময় টিভির চট্টগ্রামের ব্যুরোপ্রধান কমল দে ও ডেইলিস্টার–এর সাংবাদিক অনুরূপ টিটুকে। জানতে পারলাম, ফায়ার সার্ভিসের দলের সঙ্গে হাটহাজারী হয়ে রাঙামাটি যাওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। কিন্তু রাউজানের কয়েকটি স্থানে সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে যেতে পারছেন না। তাঁরা আবার চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে ওঠার জন্য শহরের দিকে আসতে লাগলেন। আমিও বের হয়ে পড়লাম। তাঁদের বললাম, কুয়াইশ এলাকায় দাঁড়াতে। পরে আমিও যোগ দিলাম ফায়ার সার্ভিসের বহরে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, আগে থেকেই ফায়ার সার্ভিসের বহরের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক জেমস গোমেজ। তিনিও ক্ষয়ক্ষতি দেখে ত্রাণের বিষয়টি কী করা যায়, তার জন্য রাঙামাটি যাচ্ছেন।

জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিসের দলে ছিলেন ৬০ জন সদস্য। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। হাটহাজারী পার হওয়ার পর পথে পথে দেখলাম, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে কৃষিজমি। রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ার অংশে পানি বেশি। কাপ্তাই যেতে যেতে খবর নিতে শুরু করলাম। প্রথম আলোর রাঙামাটির আলোকচিত্রী সুপ্রিয় চাকমা ও বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি সাধন বিকাশ চাকমা জানালেন, কাপ্তাই-ঘাগড়া সড়কও পাহাড়ধসে বন্ধ হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও খোঁজ নিলেন। ঘটনা সত্য। আরেকটি বিকল্প সড়ক হচ্ছে কাপ্তাই-আসাম বস্তি সড়ক। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সড়কটির বিভিন্ন অংশে পাহাড়ধসে বন্ধ হয়ে গেছে।

তিন সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়ে গেলেন ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিনসহ বাকিরা। পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, নৌপথেই রাঙামাটি পৌঁছাতে হবে। কারণ, সেখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেক মরদেহ আছে বলে জানা গেছে। পরে কাপ্তাই উপজেলা কার্যালয়ে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো থামল। কাপ্তাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তারিকুল আলম দুটি বড় ইঞ্জিনচালিত স্টিমার ঠিক করে দিলেন।

এরপর ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু যেতে যেতে দেখলাম, কাপ্তাই সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে মাটি পড়ে রয়েছে রাস্তার ওপর। কয়েকটি স্থানে সড়কটিতে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। কাপ্তাই ঘাটে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় বড় যন্ত্রপাতি ও জেনারেটর তোলা হলো স্টিমারে। এরপর যাত্রা শুরু হলো। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ১০টা প্রায়।

স্টিমার চলতে শুরু করল। কাপ্তাই হ্রদের পানি ততক্ষণে ঘোলা। মাঝিমাল্লারা বললেন, পাহাড়ধসের কারণে পানি ঘোলা হয়ে গেছে। হ্রদের দুই পাশে যেদিকে চোখ যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের ক্ষতচিহ্ন। ধসের কারণে ধূসর রং ধারণ করেছে পাহাড়। কোথাও গাছপালা নিয়ে, কোথাও বাড়িঘর কিংবা কোথাও কেবলই পাহাড় ধসে পড়ে মিশেছে হ্রদের সঙ্গে।

প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর রাঙামাটি শহর আস্তে আস্তে চোখে পড়ছে। কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ল ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ! ডিসির বাংলো, এসপির বাংলো, তবলছড়ি, রিজার্ভ বাজারসহ শহরের বিভিন্ন অংশ হ্রদ থেকে দেখা যাচ্ছে। এসব স্থানে পাহাড় ধসে পড়ার চিহ্ন স্পষ্ট। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বনরূপা ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়ের পাশে স্টিমার থেকে নামলাম। নেমেই সবাই দৌড়াতে শুরু করলাম শহরের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ভেদভেদীতে। যেতে যেতে দেখলাম, পুরো শহরের বিধ্বস্ত অবস্থা। সড়কের বিভিন্ন স্থান ধসে গেছে। বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে স্থানে স্থানে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে অটোরিকশা। বড় যান চলাচল বন্ধ। যেদিকে চোখ যায় কেবল ধ্বংসস্তূপ। শহরের সার্কিট হাউস, পাসপোর্ট অফিস, টেলিভিশন ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহাড়ধসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। তাই এলাকাগুলো বিদ্যুৎহীন। সবুজ রাঙামাটি যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ।

ভেদভেদী মুসলিমপাড়ায় গিয়ে স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দেখা পেলাম। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন সহকর্মী সাধন বিকাশ চাকমা। তিনি জানালেন, রাঙামাটির শতাধিক স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। নিখোঁজ কী পরিমাণ, এর সঠিক পরিসংখ্যানও প্রশাসনের কাছে নেই। পর্যাপ্ত কর্মীর অভাবে ঠিকমতো এগোচ্ছে না উদ্ধারকাজও। ভেদভেদী মুসলিমপাড়ায় ধ্বংসস্তূপে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। যোগ দিলেন চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও। ভাই খুঁজছে বোনকে, মা খুঁজছেন ছেলেকে, ছেলে খুঁজছে বাবাকে! যেদিকে যাই, কেবল আর্তনাদ। কোথাও প্রাণের চিহ্ন নেই। ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হচ্ছে এক–একটি শিশু, নারী ও পুরুষের মরদেহ। স্বজনদের আর্তনাদ চোখে জল এনে দেয়!

প্রাণহীন বিধ্বস্ত এই জনপদের সংবাদ সংগ্রহ শেষে তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা ছিল আরেক চ্যালেঞ্জ। কারণ, বিদ্যুৎহীন শহরে ল্যাপটপ চার্জ দেওয়া কঠিন। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় জ্বালানি–সংকট ছিল। পরে অনেক অনুরোধের পর হোটেল কর্তৃপক্ষ একটা সময় পর্যন্ত জেনারেটরের সুবিধা দেওয়ায় সে যাত্রায় পার পেয়েছিলাম। তবে ওই যে বললাম, প্রাণহীন শহর, সতি্যই তেমনটা হয়ে উঠেছিল সবুজ রাঙামাটি!