রোহিঙ্গা এবং প্রতিবেদনের ঢল

সাগর থেকে দুটি রোহিঙ্গা শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। ছবি: লেখক
সাগর থেকে দুটি রোহিঙ্গা শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। ছবি: লেখক

১৪ আগস্ট রাত আনুমানিক ১০টা। বেজে উঠল মুঠোফোনটি। কক্সবাজার থেকে ফোন করলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস। বললেন, ‘চোখ-কান খোলা রাখবে, মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গার ঢল নামতে পারে। সকালে খোঁজখবরের পাশাপাশি রোহিঙ্গা বস্তিতে সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবেদন করতে হবে।’

ঠিক পরদিন সংবাদ পাঠানো হলো, ‘রাখাইনে নতুন সেনা অভিযান, ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ’। ১৬ আগস্ট প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

তারপর থেকে প্রতিদিনই পাঠাতে লাগলাম রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সংবাদ। শুরু হলো রোহিঙ্গা বস্তিগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত।

৩০ আগস্ট বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় হঠাৎ করে ফোন পেলাম টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে। অপর প্রান্ত থেকে স্থানীয় বাসিন্দা জসিম মাহমুদ জানালেন, শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে প্রচুর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে এবং নৌকাডুবির ঘটনাও ঘটেছে। নৌকাডুবির সর্বশেষ সংবাদটি পরের দিনের প্রতিবেদনে দিলাম আমি। আগের দিন একটি নৌকাডুবির ঘটনায় নাফ নদী থেকে ৪ জনের লাশ এবং ওই রাতে আরও ২ জনের লাশ উদ্ধারের প্রতিবেদনটিও ছাপা হয় পত্রিকায়।

রোহিঙ্গাবোঝাই একের পর এক নৌকাডুবির খবর পেয়ে রাতে আর ঘুম হলো না। মনস্থির করলাম খুব ভোরে শাহপরীর দ্বীপে রওনা হব। নির্ঘুম রাত কাটানোর পর ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘর থেকে বেরিয়ে অটোরিকশায় শাহপরীর দ্বীপের উদ্দেশে হারিয়াখালী রওনা হলাম। ওখানে গিয়ে অটোরিকশা থেকে নেমে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে স্পিডবোট ধরে পৌঁছাই শাহপরীর দ্বীপ উত্তরপাড়ায়। সেখান থেকে আবার অটোরিকশায় শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া সৈকতে পৌঁছানোর পর দেখা গেল রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুরা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজছে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক সকাল ছয়টা। তীরে ভেড়ানোর আগেই সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়তে দেখলাম একটি রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা। চোখের সামনে নৌকাটি ডুবে গেল। সৈকতে থাকা স্থানীয় কিছু জেলে ও লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে নারী-পুরুষ-শিশুদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এভাবে চলতে থাকে স্থানীয়দের উদ্ধার তৎপরতা। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল সৈকতের বালুতে জড়ো করা হয়েছে শিশু, নারী ও পুরুষের ৯টি মরদেহ।

ঠিক ৬টা ৪৩ মিনিটে দুজন লোককে দেখলাম সাগর থেকে মাথার ওপরে কী যেন দুটি তুলে সৈকতের দিকে আনছেন। নজরে আসতেই ক্যামেরাটি তাক করলাম ওদিকে। তখনও বুঝে উঠতে পারিনি দুটি শিশুর মরদেহ তুলে আনছেন লোক দুটি। সকালের নৌকাডুবির ঘটনায় শিশু দুটি পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। ঘটনাস্থল থেকে নৌকাডুবির সংবাদটি দিলাম প্রথম আলোর অনলাইনে। সংবাদের সঙ্গে পাঠাতে পারলাম একটিমাত্র ছবি। তখনো আমি ছাড়া অন্য কোনো গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে যাননি। অথচ পরদিন আমার তোলা ছবিটিই নিজেদের ছবি হিসেবে প্রকাশ করে একাধিক গণমাধ্যম।

প্রতিদিনই একেকটি ঘটনা ঘটে আর যন্ত্রের মতো লিখে যাই। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। অসহায়, নিরন্ন মানুষের জীবন নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা যে কী অসহনীয় মানসিক চাপের জন্ম দেয়, তা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সংবাদ লিখতে গিয়ে বুঝেছি। এখনও প্রতিদিন চলমান এই সংকট নিয়ে লিখতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা এবং এই সংশ্লিষ্ট আমার করা প্রতিবেদনের ঢল নেমেছে পত্রিকার পাতায়। জানি না, আরও কতদিন এভাবে লিখে যেতে হবে। এটাই মনে হয় সাংবাদিকতার মাধুর্য!