চট্টগ্রাম আর নতুন মলাটের কথা

লেখার বিষয় ‘মলাট’। ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। বছরের শুরুতে নতুন বই হাতে পেলেই পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতা বা অন্য কোনো মোটা কাগজ খুঁজতাম মলাট করার জন্য। নতুন বই যেন নতুনই থাকে, যেন ময়লা না লেগে যায়। কিন্তু আজ যে মলাটের কথা বলছি, সেটা ভিন্ন। এটি দৈনিক পত্রিকার মলাট। প্রথম পাতা ঢেকে দেওয়ার বিশেষ একটা বর্ণাঢ্য আয়োজন। আমাদের বিজ্ঞাপন বিভাগের সহকর্মীরা ইংরেজিতে বলেন ‘জ্যাকেট’। আমরা গায়ে যে জ্যাকেট পরি, সেটার নানা স্টাইল থাকে। বিজ্ঞাপনের জ্যাকেটও সে রকম কারুকাজ থাকে। তাই হয়তো তাঁরা জ্যাকেট বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

পত্রিকার মলাট করতে চাইলে প্রথমে ‘ইস্যু’ নিয়ে ভাবতে হয়। ইস্যুটা এমন হতে হবে, যেটা প্রথম পাতাকে ঢেকে ফেলে নিজেকে তুলে ধরবে। বিষয়ের গুরুত্ব এবং পাঠকের চাহিদা, রুচি সবই সমানভাবে বিবেচনায় রাখতে হয়। প্রথম আলো প্রথম যে মলাট বের করেছিল, সেটা সেতু নিয়ে। ২০০৮ সালের ১৮ মে প্রকাশিত সেই সংখ্যায় বিষয়ের গভীরতা ছিল। আর ছিল প্রভাবশালী ক্ষমতাধরদের বেপরোয়া দুর্নীতির প্রকাশ। সড়ক নেই অথচ যেখানে–সেখানে সেতু বানিয়ে কীভাবে টাকা লোপাট করা হয়েছে, তার প্রামাণ্য দলিল ওই মলাটসংখ্যাটি তখন দেশময় বেশ আলোচিত হয়েছিল।

এ রকম বিষয়ে লেখা আর ছবি নিয়ে সংবাদপত্রের প্রথম ও শেষ পাতা ঢেকে দেওয়া যায়। সেই সংখ্যাটি আবার পাঠকের কাছে অতি আকর্ষণীয় হতে পারে—সেটা এর আগে আমরা কখনো ভাবিনি। এই ধারণাটি বাংলাদেশে প্রথম। তখন দেখেছি, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান আমাদের সঙ্গে নিয়ে কী উৎসাহ নিয়ে দিনরাত খেটে কাজটি এগিয়ে নিয়েছেন!

তারপর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বিডিআর বিদ্রোহ, ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ঢাকার ৪০০ বছর, ছিটমহল, তিস্তা—ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম আলো বিশেষ মলাটসংখ্যা বের করেছে। তবে ঢাকার বাইরের কোনো জেলা বা এলাকার ইস্যু নিয়ে আমরা এ ধরনের বড় কাজ শুরু করেছি সাম্প্রতিক সময়ে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা বিশেষ মলাট বের করি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে। সন্দেহ নেই, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ইস্যুটি এবার অন্য সময়ের চেয়ে বেশি আলোচিত। ‘জলাবদ্ধ চট্টগ্রাম’ নিয়ে এ বছরের ৯ জুলাই প্রকাশিত মলাটসংখ্যাটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

তবে চট্টগ্রামকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া বা চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে মলাট কভারেজ কেন? সেটা একটু বলি। আসলে ঢাকার পরই চট্টগ্রামে প্রথম আলোর পাঠকপ্রিয়তা বেশি। সারা দেশের মতো এই অঞ্চলের মানুষও প্রথম আলোকে অনেক বেশি ভালোবাসেন।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আমরা চট্টগ্রাম শহর ঘুরে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্থানীয় ইস্যু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। যা নিয়ে কাজ করলে মানুষ উপকৃত হবে। মানুষ যা নিয়ে ভাবছে, যা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে, যার কারণে ভোগান্তির মুখে পড়ছে, এমন সব ইস্যু। একপর্যায়ে আমরা চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে জলাবদ্ধতার কষ্টের কথা শুনতে পাই। বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা। এ কারণে সড়ক ভেঙে হয়েছে খান খান। এই ভোগান্তি মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। ব্যবসা–বাণিজ্যে নেমে এসেছে স্থবিরতা। বন্দরের সমস্যায় ব্যবসায়ীরা ভুগছেন সারা বছর। ফলে সম্পাদকের পরামর্শে আমরা এ বিষয়ে মলাট বের করার পরিকল্পনা করি। এর উদ্দেশ্য ছিল সমস্যাটি যে কত বড়, মানুষের কষ্ট যে কত গভীর তা তুলে ধরা এবং এর সমাধানে করণীয়গুলো জোরের সঙ্গে বলা। যাতে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়। পরে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অফিসে বিশেষ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে আমরা বিশেষজ্ঞদের অভিমত ও সুপারিশগুলো তুলে ধরি।

তারপর স্থানীয় ইস্যু নিয়ে আমরা দ্বিতীয় মলাট বের করি ১৩ আগস্ট। সেটা ছিল রাঙামাটির পাহাড়ধসের ঘটনা নিয়ে। সেটিও বেশ সাড়া ফেলেছিল। এ রকম বড় কাজের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা সত্যিই আনন্দের। এই চেষ্টার মাধ্যমে কতটুকু সাফল্য এসেছে জানি না। তবে বলতে পারি, আমরা প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আমাদের চট্টগ্রাম অফিসে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। উপবার্তা সম্পাদক ওমর কায়সারের নেতৃত্বে সেখানে দুই জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক আশরাফউল্লাহ ও আহমেদ মুনীর এবং সহসম্পাদক সাঈদা ইসলাম সকাল থেকেই দিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠেন। জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক একরামুল হক, প্রণব বল ও মাসুদ মিলাদ, প্রতিবেদক গাজী ফিরোজ ও সুজন ঘোষ এবং দুই ফটোসাংবাদিক সৌরভ দাশ ও জুয়েল শীলও প্রশংসনীয় কাজ করছেন।

চট্টগ্রাম সংস্করণের তিনটি পৃষ্ঠার সব কাজ এখন চট্টগ্রাম অফিস থেকেই হয়। এ বছরের ৩১ মে থেকে প্রতিদিন তিনটি পৃষ্ঠার পরিকল্পনা, প্রতিবেদন ও ফিচার লেখা–সম্পাদনা, ছবি তোলা, বাছাই, পাতার মেকআপ—সব কাজ চট্টগ্রাম থেকেই হচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের আওতাধীন জেলা ও উপজেলা থেকে পাঠানো প্রতিবেদন তৈরি ও সম্পাদনাও হচ্ছে সেখানেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁরাই যোগাযোগ করছেন। আগে চট্টগ্রাম অফিস থেকে সপ্তাহে দুদিন ‘আমার চট্টগ্রাম’ নামে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হতো। এখন চট্টগ্রামের পাঠকের জন্য প্রতিদিন তিনটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ। তার ওপর প্রথম ও শেষ পাতা; বাণিজ্য ও অন্যান্য পাতায়ও চট্টগ্রামের খবর থাকছে নিয়মিত। বিশেষ প্রতিবেদনের পাশাপাশি খেলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খবরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নিয়মিতভাবে থাকছে ইতিবাচক খবর।

চট্টগ্রাম অফিসের গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা রকমের আয়োজন তদারক করেন যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি সাপ্তাহিক বৈঠকগুলোতেও উপস্থিত থাকেন। সম্পাদকীয় পাতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কলাম লেখেন নিয়মিত।

শুধুই কি বার্তা বিভাগ? আরও আছে ঢাকার মতো সার্কুলেশন বিভাগ, আছে বিজ্ঞাপন বিভাগ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগ দুটিও সেখানে বেশ সচল। শামীমুল হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিভাগ দুটি পাঠকসংখ্যা বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি এবং বুদ্ধি খাটিয়ে স্থানীয় বিজ্ঞাপন সংগ্রহের চেষ্টায় সাফল্য পেয়েছে। বার্তা, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন বিভাগ যেন গলা ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। এই সাফল্যের পেছনে আরও একজনের নাম উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন ঢাকায় কর্মরত মোমেনূর রশীদ সিদ্দিকী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রধান, মার্কেটিং ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট)।

শুধু চট্টগ্রাম নয়, প্রথম আলোর সব বিভাগীয় ও জেলা শহর নিয়ে আমরা বড় কাজ করার পরিকল্পনা করছি। আশা করছি, আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধরে আমরা আরও মলাটসহ নতুন নতুন চিন্তা নিয়ে হাজির হব।