আতিয়া মহলে 'অপারেশন টোয়াইলাইট'

আতিয়া মহলে অভিযান। ছবি: লেখক
আতিয়া মহলে অভিযান। ছবি: লেখক

২৪ মার্চ শুক্রবার। ভোর। ঘুমের ঘোর কাটেনি। ফোন করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল মেহেদী। সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, ‘দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযান চলছে, দ্রুত যাও। আপডেট জানিয়ো। আমি আসছি।’

দ্রুত ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইক চেপে পৌঁছে গেলাম ঘটনাস্থলে। জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে আতিয়া মহল নামের পাঁচতলা ভবনটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। পাশের ভবন থেকে নিরাপদে বেরিয়ে পড়ছে অনেক বাসিন্দা। ফাঁকা গুলি ছোড়ার পাশাপাশি হ্যান্ডমাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে বলছে পুলিশ। সংবাদকর্মীরা খবর আর ছবির জন্য ছুটছেন ভবনের এক পাশ থেকে আরেক পাশে।

সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে এল বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস)। জঙ্গি আস্তানায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক থাকায় সোয়াট দল অভিযানে না নেমেই ফিরে গেল। ভাবলাম, কাল শনিবার দুপুরের মধ্যেই অভিযান শেষ হবে। বাকি সংবাদকর্মীদের সঙ্গে রাত কাটালাম সড়কের পাশে, না ঘুমিয়ে।

রাতজাগা ক্লান্ত শরীরে ২৫ মার্চ শনিবার সকালে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম। ক্লান্তি ছুঁয়েছে কিন্তু তারপরও কড়া সতর্কতায় আছে পুলিশ–র‍্যাব। জঙ্গি আস্তানায় আটকে আছে নারী, পুরুষ, শিশুসহ বেশ কয়েকটি পরিবার। হঠাৎ দেখি, একটা সাদা সাঁজোয়া যান। জানতে পারলাম, ১৭ পদাতিক সেনাবাহিনীর সেনা কমান্ডোরা এসেছেন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ক্যামেরায় ছবি তুলছি। সেই ছবি দ্রুত পাঠাচ্ছি প্রথম আলো অনলাইনে। ততক্ষণে আতিয়া মহলের চারদিক ঘিরে ফেলেছেন সেনা কমান্ডোরা। রেললাইনের পাশে উত্সুক জনতার ভিড়।

হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে বৃষ্টির মতোই গুলির শব্দ। দিগ্‌বিদিক ছুটতে লাগল উত্সুক জনতা। এর মধ্যেই জঙ্গি আস্তানার খবর সংগ্রহ করতে ঘটনাস্থলে এসেছেন প্রথম আলোর অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা। তাঁর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। বৃষ্টির মধ্যে সেনাবাহিনীর সদ্যসরা ভেতরে আটকাপড়া লোকজনদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। দূর থেকে সেই ছবি তোলার জন্য আমিও বসে নেই। সকাল ১০টার দিকে সাধারণ মানুষের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সেনা কমান্ডো সাংবাদিকদের জানালেন, ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু হয়ে গেছে।

দিনভর শোনা গেল বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। সকাল-দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যায় সেনা কর্মকর্তাদের সংবাদ সম্মেলন শুরু হলো আতিয়া মহলের পাশেই একটা বাসায়। সেখানে রাখা হয়েছে জঙ্গি আস্তানা থেকে সরিয়ে আনা ৭৮ জনকে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হলো অপারেশন টোয়াইলাইট চলবে।

সংবাদ সম্মেলন শেষ। পাঠানপাড়ার অন্ধকার গলি ধরে আমরা কজন সংবাদকর্মী ফিরে আসছিলাম। ঠিক সে সময় বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। কী যেন একটা ধাক্কা দিয়ে গেল! উজ্জ্বল মেহেদী পড়ে গেলেন মাটিতে। সেই ধাক্কা সইতে হলো আমাকেও। প্রথমে ভাবলাম, জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরণ। কিন্তু আশপাশেই মানুষের আর্তনাদ, রক্তাক্ত মানুষের ছোটাছুটি দেখে বুঝতে পারলাম বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে আমাদের খুব কাছেই! খুব ভয় পেলাম। চেষ্টা করলাম নিরাপদ জায়গায় দৌড়ে যাওয়ার জন্য। পরে মানুষের স্রোতের বিপরীতে ক্যামেরা নিয়ে একটু এগোতেই দেখি, মাটিতে পড়ে আছে রক্তাক্ত মানুষ। চিত্কার করে বলছে, ‘বাঁচান ভাই, বাঁচান!’

আরও অনেকের সঙ্গে হাত লাগালাম আহত ব্যক্তিদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে। পাশাপাশি ক্যামেরার ক্লিক বাটনে চাপ দিচ্ছি সমানতালে। ঠিক সে সময়ে আরও একটা বিস্ফোরণ হলো পাঠানপাড়া মসজিদের সামনে! পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারালেন র‍্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান, পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ সাতজন। এদিকে সহকর্মী গোলাম মর্তুজা ও সুমনকুমার দাশের ফোন, ‘আনিস, আপনি ঠিক আছেন তো?’ ঠিক আছি শুনে হাঁফ ছাড়লেন দুজনই। মুঠোফোনে স্বজনেরা জানতে চাইছে, আমরা ঠিক আছি কি না। জানালাম, ঠিক আছি। দ্রুত অফিসে গিয়ে দেখি, সহকর্মীদের চোখে-মুখে আতঙ্ক আর বেঁচে যাওয়ার আনন্দ!

২৬ মার্চ জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলের আশপাশে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হলো। কাছে যাওয়া যাবে না। তাই দূর থেকেই ছবি তুলতে হচ্ছে। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা বিস্ফোরণের শব্দ দূর থেকেই কানে আসছে। প্রতি মুহূর্তে বিকল্প পথ খুঁজছি একটা ভালো ছবির আশায়। নিরাপদে থেকে কীভাবে ভালো ছবি তোলা যায়, ভাবছি সারাটাক্ষণ।

২৭ মার্চ দিনটাও কাটল একইভাবে। জঙ্গি আস্তানার এক কিলোমিটার দূরে অপেক্ষমাণ শতাধিক সাংবাদিক। ক্লান্ত শরীরে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন সড়কের পাশে। সবার একটাই চাওয়া, অভিযান দ্রুত শেষ হোক। বেঁচে যাক আটকে থাকা মানুষ।

২৮ মার্চ সকাল থেকে একটানা অভিযান চলল। জঙ্গিদের সঙ্গে লড়ে গেলেন সেনা কমান্ডোরা। গুলি আর বিস্ফোরণের কারণে আতিয়া মহলের ওপরে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেল দুপুরের দিকে। সেই ধোঁয়া ওড়ার ছবি তুললাম দূর থেকে। বিকট শব্দ ভেসে আসছে নিয়মিত সংক্ষিপ্ত বিরতিতে। একটু পরপর আতিয়া মহলের ভেতরে যাওয়া–আসা করছে সেনাবাহিনীর যান, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। ততক্ষণে বুঝতে পারলাম, জঙ্গিদের প্রতিহত করতে পেরেছে সেনা কমান্ডো দল। দিনের আলো নিভে যাচ্ছে। পশ্চিমের আকাশে লাল হয়ে আছে সূর্য। আতিয়া মহল থেকে সাঁজোয়া যানের ওপরে বসা উচ্ছ্বসিত সেনা কমান্ডোরা বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে জানান দিলেন, ‘অপারেশন টোয়াইলাইট সাকসেসফুল’!

একইভাবে ২৯ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল—প্রতি মুহূর্তে চাপা উত্তেজনা নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করি মৌলভীবাজারের জঙ্গি অভিযান ‘হিটব্যাক’ ও ‘ম্যাক্সিমাস’। ছবিগুলো ছাপা হয় প্রথম আলোয়। ঘরে ফিরে ক্যামেরার চোখে দেখা ঘটনাগুলো রাত জেগে শোনাই স্বজনদের। অপেক্ষায় থাকি নতুন সূর্য ওঠার।