কুয়ালালামপুরের গণআদালতে

গণ–আদালত বসেছিল কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে। ছবি: লেখক
গণ–আদালত বসেছিল কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে। ছবি: লেখক

১৮-২২ সেপ্টেম্বর গণ–আদালত বসেছিল কুয়ালালাম–পুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে। ১৪ সেপ্টেম্বর আমি খবরটি পেয়েছিলাম অধ্যাপক সি আর আবরারের কাছ থেকে। ওই দিনই প্রথমআলো সম্পাদক মতিউর রহমান আমার কাছে তা শোনামাত্র বললেন, ‘ভিসা নাও। ছোটো।’ তখন বৃহস্পতিবারের রাত।

রোববার ১৭ সেপ্টেম্বরের আগে ভিসা আবেদন করারই জো নেই। অনলাইনে ভিসা ফরম পূরণের পরে বুঝলাম, এটা অনিশ্চিত। প্রমাদ গুনলাম। আমি একটা দীর্ঘ সময় কূটনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবারিত সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করলেন। তাঁরা ঢাকায় মালয়েশীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু তিনি তখন ষোলো আনা নিশ্চিত করেননি।

ইতিমধ্যে ডবল আমন্ত্রণপত্র জোগাড় হলো। গণ-আদালতের সভাপতি আর্জেন্টাইন জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন ও কম্বোডীয় ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যুক্ত থাকা হেলেন জারভিস বহুবার বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁরা আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। সেই সূত্রে গবেষক-লেখক মফিদুল হক দ্রুতই আমার জন্য একটি আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করলেন। ততক্ষণে আমি জেনে গেছি যে হুইলচেয়ারে বিশ্বময় চষে বেড়ানো প্রখ্যাত মালয়েশীয় বুদ্ধিজীবী ড. চন্দ্র মোজাফফর হলেন এই গণ-আদালত আয়োজনকারী মোর্চার সভাপতি। ২০০৩ সালে চীনের ইয়ানান বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতিগত সংখ্যালঘুদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। সেই সুবাদে আরও একটি আমন্ত্রণপত্র জুটল। তবে ১৭ সেপ্টেম্বর হতাশ হতে হলো। কারণ, ১৬ সেপ্টেম্বর ছিল মালয়েশিয়ার সরকারি ছুটি। বাংলাদেশে সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ১৭ সেপ্টেম্বরেও মালয়েশীয় হাইকমিশন বন্ধ থাকল। তাই আদালতের প্রথম দিনে গরহাজির থাকতে হলো।

১৮ সেপ্টেম্বর সকালে জমা পড়া পাসপোর্ট সন্ধ্যায় পেয়ে মধ্যরাতেই প্রসন্নচিত্তে সম্ভব হলো আকাশে ওড়া। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে সরাসরি মালয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই গণ-আদালত বসেছে। এই আদালতের দৃশ্যপট মনে করিয়ে দিল, খুব শিগগির বিশ্বময় আদালতকক্ষের চিরচেনা দৃশ্য পাল্টে যাবে। কারণ, সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে অডিও ভিজু্যয়ালের ব্যাপক ব্যবহার। ‘পলাতক’ অভিযুক্তদের কৌসুঁলি হিসেবে রোমভিত্তিক পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের (পিপিটি) সমন্বয়ক মিজ সিমোনা ফ্রদাতারিও ওয়েবসাইট ঘেঁটে বর্মী ভাষ্যগুলো হাজির করলেন। সূচির ভাষণ বাজানো হলো।

সেখানে গিয়ে তিনটি গল্প শুনলাম। বর্মীরা রোহিঙ্গাদের কখনো রোহিঙ্গা বলেনি, নিকট অতীত থেকে বলছে কালার। রাজাকারের মতো ‘কালার’ পরিণত হয়েছে ঘৃণাসূচক শব্দে। অথচ কালার একদা অত্যন্ত মর্যাদাকর শব্দ ছিল। সেখানে এক বৌদ্ধ মানবাধিকারকর্মী ড. মং জার্নির সঙ্গে আলাপ হলো। জার্নি বেশ হাসিখুশি, দিলখোলা। হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডে পড়ান। তাঁর সঙ্গে দ্রুত ভাব হলো। ঢাকায় এলে প্রথম আলোতে তিনি আসবেন, আমাদের জন্য লিখেছেনও ইতিমধ্যে।

 অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। অমর্ত্যের শৈশব শুধু পুরান ঢাকাতেই নয়, একাংশ মান্দালেতে কেটেছে। অমর্ত্যের বাবা মান্দালের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, সেই অঞ্চলেই মং জার্নির নিবাস। সু চি ও জার্নির দাদা রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই হলে পড়শি ছিলেন। এতসব কথা জার্নি আমাকে বলেছিলেন মালয়েশীয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের শ্রমে-ঘামে গড়া আলিশান পাঁচতারকা হোটেল পুলম্যানে।

অমর্ত্য আবার অং সান সু চির অর্থনীতির শিক্ষক ও তাঁর স্বামী অ্যারিসের জানি দোস্ত ছিলেন। ক্ষমতা নেওয়ার পরে প্রথম গুরু দর্শনের পরে অমর্ত্য সু চিকে বলেছিলেন, তোমাকে হতে হবে রোহিঙ্গাসহ সকলের নেত্রী, কিন্তু পরে সু চি-কাণ্ডে হতাশ অমর্ত্য। বৌদ্ধ ধর্মানুসারী জার্নি কয়েক মাস আগে অমর্ত্যকে সাফ জানিয়েছেন, মিলিটারির চাপটাপ ভুয়া, ব্যক্তি সু চি যে অতিশয় বর্ণবাদী, সে বিষয়ে তাঁর যেন কোনো সংশয় না থাকে।

১৯৬১ সালেও বর্মী সামরিক বাহিনীর চোখে রোহিঙ্গারা আরাকানি সংখ্যালঘু হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এটা শুনে মুহূর্তে মনে হলো, আমাদের মানে বাংলাদেশি মিডিয়া ও সামাজিক মিডিয়ার কাজ হবে, নতুন প্রজন্মের বর্মী হৃদয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্মী সমাজের সেই ভালোবাসা ও মমতামাখা স্মৃতিগুলো জাগ্রত করা। এই দেশটির সঙ্গে আমাদের ভূখণ্ডের বিবাদবিসম্বাদই পরতে পরতে, তবে মৈত্রী একেবারেই নেই, তা নয়। ১৭৮৭ সালে বর্মী রাজা বোঁধোপায়া চট্টলাবাসীর সঙ্গে সন্ধি করতে তাঁর ৩০ জন লোকলষ্কর দিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের কাছে চারটি গজদন্ত উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।

 প্রায় ১০০০ থেকে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয় দার্শনিক, কুলিন ব্রাহ্মণের মতো উচ্চপদস্থ অভিজাতদের কালার বলা হতো। কিন্তু ১৮২৪ সালের পরে ‘নিচু’ কুলি-কামিনরা যখন ভারত থেকে রেঙ্গুনসহ বিভিন্ন শহরে ব্যাপকভাবে আসতে শুরু করল, তখন বর্মীদের চোখে কালারদের প্রতি সম্ভ্রমবোধের একটা ঘাটতি শুরু হলো। আর সেটা এখন অশিষ্ট গালিতে পরিণত হয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টনিউইয়র্ক টাইমস এখন লিখছে, কালার মানে ‘কালো-নিগ্রো’, ক্রীতদাস অর্থে, যা রোহিঙ্গাদেরই বলা হয়।

আর দুটি গল্প অসমর্থিত। এর একটি হলো সংস্কৃতিতে ‘রোহ’ মানে পর্বত। উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাহাড়ঘেরা একটি অঞ্চলের নাম রোহ। উত্তরপ্রদেশের রোহেলখান্দের রোহিলা পাঠান (আফগান রোহিলা উপজাতিদের নামানুসারে) আছে। ব্যুৎপত্তি-সংক্রান্ত তৃতীয় গল্পটি হলো আরবি ‘রহম’ শব্দের অর্থ হলো দয়া বা করুণা। অষ্টম শতকে বর্মী উপকূলে একটি আরব নৌকা বিধ্বস্ত হয়। তখন তারা স্থানীয় রাজার কাছে ‘রহম’ প্রার্থনা করেন। আরাকানে মুসলিম বসতির সেই শুরু।

কুয়ালালামপুরে গিয়ে আরেকটি অভিজ্ঞতা হলো যে মিয়ানমারের সমাজে রোহিঙ্গাবিরোধিতা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তারা মুসলিম কি মুসলিম নয়, সেটাই তাদের নিগ্রহের কারণ নয়।

রোহিঙ্গাদের পরে সব থেকে গুরুতর নির্যাতনের শিকার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী কাচিন। গণ শুনানিকালে একটি ফুটেজে দেখা গেল, কাচিনপল্লীর নারীদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে বর্মী বদমাশরা গাছে গাছে অতিকায় কনডম ঝুলিয়ে রেখেছে!

বর্মী জেনারেলরা ইতিহাস বিকৃত করেছেন। তাঁরা স্বপ্ন, মৌলবাদ, ঝাড়ফুঁক ও তুকতাক ফেরি করেছেন, এখনো করছেন। জ্যোতিষীর কথামতো তাঁরা ইয়াঙ্গুন থেকে প্রশাসনিক রাজধানী রাতারাতি নেপিডোতে সরিয়েছেন। সর্প ও কিট ধরনের প্রাণী থেকে রোহিঙ্গাদের পুনর্জন্ম ঘটেছে, এই বিশ্বাসে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু রোহিঙ্গাদের কচুকাটা দোষণীয় মনে করেন না। সেনারা জনগণের মধ্যে এই গুজব বিশ্বাসযোগ্যভাবে ছড়িয়েছেন। এসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করতে কার মন সায় দেবে, বলুন? কিন্তু সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস-এর সরেজমিন প্রতিবেদনেও তা–ই এসেছে।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে তাদেরকে প্রথম বিতাড়নের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের শুরু হয়েছে, তা মোটেই সত্য নয়।

এবারে বলি রোমভিত্তিক পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের (পিপিটি) পেছনের কথা। আন্তর্জাতিক গণ–আদালতের এই ধারণাটি নোবেলজয়ী ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের। ১৯৬৬ সালে এর প্রথম অধিবেশনের উদ্যোক্তা ছিলেন ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং তার পরররাষ্ট্রনীতির সুলুক সন্ধানই ছিল তাদের ওই যাত্রার লক্ষ্য। রাসেল-সার্ত্রের ওই উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গুরুত্ব দেয়নি, সেভাবে মিয়ানমারের ছদ্মবেশী সামরিক সরকারও কিন্তু পিপিটিকে পাত্তা দেয়নি। ৭০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়, যাতে সূচি ও তাঁর সামরিক পরিষদের নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারকে জেনোসাইডের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার আইনি নয়, রয়েছে নৈতিক ভিত্তি। মিয়ানমারের আগে দেশে দেশে মানবাধিকার বিষয়ে ৪৩টি ট্রাইব্যুনাল বসেছে।

লাতিন আমেরিকার সামরিক স্বৈরশাসকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পিপিটির রায়গুলো বর্ম হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের এই অঞ্চলে এর আগে ভারতে পিপিটি বসেছে। পিপিটির ওয়েবসাইটে আমাদের প্রয়াত বিচারপতি কে এম সোবহান ও ভারতের সেন্টার ফর উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মেরি ই জনের নাম দেখলাম। কুয়ালালামপুরে যাওয়ার আগে ড. মেরির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলো। তিনি জানালেন, ২০১২ সালে বেঙ্গালুরুতে গার্মেন্টস কর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একটা ট্রাইব্যুনাল হয়েছিল। তিনি তার অন্যতম বিচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইলেন না।

উল্লেখ্য, রাসেল-সার্ত্রেদের সঙ্গে ইতালীয় সিনেটর ও আইনজীবী লিলিও বাসোও কাজ করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি পিপিটির কাঠামোকে স্থায়ী রূপ দেন। রোমে এর সদর দপ্তর। আমাদের জাতীয় জীবনের যে অভিজ্ঞতা, তাতে এখানে যে আমরা এত দিনে পিপিটির একটি অধিবেশন করারও উদ্যোগ নিইনি, সেটা কম বিস্ময়কর নয়। অবশ্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণ–আদালত বিশ্ববাসী মনে রাখবে।

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রথম অধিবেশনটি বসেছিল লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত সেপ্টেম্বরে কুয়ালালামপুরে বসল চূড়ান্ত অধিবেশন। সাত সদস্যের বিচারক প্যানেলে ইতালীয় সুপ্রিম কোর্টের সলিসিটর জেনারেল নিলো রসি অন্যতম। ২২ তারিখে রায়দানের পরদিন তাঁর সঙ্গে কথা হলো। ইতিমধ্যে আমি সব বিচারকেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বিচারক প্যানেলে মুসলিম সদস্যরাই ছিলেন সংখ্যালঘু।

বিচারকেরা প্রায় সবাই নিজ নিজ দেশে সুপরিচিত। নিলো রসি জানালেন, সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মিয়ানমার-ইতালির সম্পর্কে তাঁর উপস্থিতির কোনো প্রভাব নেই। তিনি বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।

অন্যতম বিচারক নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী সাদি সদর বললেন, মধ্যপ্রাচ্যের উম্মাহ-কান্ডারি দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মেপে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছে। পশ্চিমা মিত্র রোহিঙ্গা ইস্যুকে কীভাবে দেখে, সেটাই তাদের পথ। এমনকি ইরানও তার বাইরে নয়।

বলাবাহুল্য, গণ–আদালতের খবর সম্প্রচারে পশ্চিমা মিডিয়ার কোনো আগ্রহ দেখিনি। স্বাগতিক মালয়েশিয়ার নাজিব রাজাকই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি এই ইস্যুতে, গণহত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছেন।

বহুকাল মনে থাকবে মার্কিন বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি স্টেনটনকে। তিনি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আমাকে বললেন, ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত একাত্তরের জেনোসাইডের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। আর রোহিঙ্গা জেনোসাইড বন্ধে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করা। কবে থেকে এমনটা ভাবছেন? বর্ষীয়ান স্টেনটন বললেন, তাঁর শিক্ষক একাত্তরেই মার্কিন নীতির নিন্দায় সোচ্চার ছিলেন।