অন্ধকার পর্দার আলো

জয়া আহসান, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
জয়া আহসান, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

আচ্ছা, মানুষ অভিনয় কেন করে?
একবার মাছবাজারের দৃশ্যটির কথা ভাবুন। একটি দোকানে সাজানো ইলিশগুচ্ছ আপনার নজর কেড়েছে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কেনাবেচা দেখলেন। এই মাছ, সেই মাছ দরদাম করলেন—পাছে দোকানি আপনার পছন্দের কথাটা টের পেয়ে ইলিশের দাম বাড়িয়ে দেন। ওদিকে দোকানিও আপনাকে পরখ করছেন—কোন মাছ আদতে আপনি কিনতে চান, কত টাকা আপনার পকেটে আছে ইত্যাদি। গুচ্ছের ইলিশগুলো ভালোভাবে পরখ করে পছন্দের দু-একটি নির্বাচনও করে ফেললেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, কোথাকার ইলিশ? ভিড়ের মধ্যে সম্ভাব্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দোকানি ব্যস্ত, ইলিশ নিয়া যান স্যার, টাটকা ইলিশ। দ্বিতীয়বার ইলিশের বাড়ির খোঁজ করাতে একটু বিরক্তির সঙ্গে দোকানি বলেন, পদ্মা ছাড়া এমুন ইলিশ আর কই পাইবেন, স্যার! ও রকম সবাই বলে, সাগরের ইলিশ পদ্মার বলে চালিয়ে দেয়। তারপর মাছটা টিপেটুপে জানান দিলেন, একটু নরম মনে হচ্ছে! নোংরা পানি ছিটিয়ে আপনাকে একটু তফাতে পাঠিয়ে বিক্রেতা পরম যত্নে মাছের গায়ে হাত বোলান। অপমানিত বোধ করে কানকো উঁচিয়ে দেখান, এই রকম জ্যান্ত ইলিশ সারা বাজার ঘুইরা একটাও পাইবেন না! বিদ্রূপের স্বরে বলেন, কী কমু স্যার, কাল রাইতে এরা পদ্মার এক পাড় থিকা ডুবসাঁতার দিয়া আরেক পাড়ে রওনা হইছিল প্রিন্সেস জরিনার ড্যান্স দেখতে। ইত্যাদি ইত্যাদি বাজে রসিকতার মধ্যে চলতে থাকে দরদাম।

এইখানে আপনি আর মাছবিক্রেতা দুজনেই অভিনয় করলেন। নেতা থেকে আমজনতা—আমরা সবাই অভিনয় করি। একটি কিশোর তার পাতলা ঠোঁটের ওপর গোঁফ এঁকে পিতার ভূমিকায় অভিনয় করে। কিশোরী যখন পুতুল খেলে, পুতুলের বিয়ে দেয়, তখন সে সংসারধর্মটিই অভিনয় করে মাত্র। জন্মের সময় শিশুর কান্না থেকে মৃত্যুর মৌনতা—সর্বত্র অভিনয়। সর্বত্র জানান দেওয়া, নিজেকে প্রকাশ করা, অভিব্যক্ত করা। অভিনয় প্রেমিকার সঙ্গে অন্য যুবকের বিয়ের অনুষ্ঠানে—প্রেমিকের আহত চোখের চাহনিতে, অভিনয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অভিনয় না করার আকুতিতে, অভিনয় রাজনীতির মঞ্চে নেতা আর জনতার বোঝাপড়ায়। জগৎ-সংসারে আমরা সবাই অভিনয় করে যাচ্ছি যার যার নির্ধারিত ভূমিকায়। অভিনয় থিয়েটারের মঞ্চে, টেলিভিশনের পর্দায়, অভিনয় সিনেমায়, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে, সেলফিতে। সর্বত্র অভিনয়।

জগৎ-সংসারে এসব অভিনয়ের সঙ্গে শিল্পী জয়া আহসানের কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে। একজীবনে আমরা হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করি, কিন্তু একজন শিল্পীর বেলায় সে সম্ভাবনা অসংখ্য। শিল্পীকে কখনো ক্রেতার ভূমিকায় দেখা যায়, কখনো বিক্রেতার। কখনোবা একই সঙ্গে দুইয়ের ভূমিকায়ও তাঁকে অবতীর্ণ হতে হয়। একইভাবে কখনো ধনী, কখনো গরিবের ভূমিকায়। চোর কিংবা পুলিশ, চিকিৎসক কিংবা রোগী, শিকার কিংবা শিকারি ইত্যাদি ইত্যাদি। বহুবিচিত্র সব চরিত্র যেন একজন শিল্পীর অবয়বে মূর্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। অভিনয়শিল্পী মূলত এক বহুরূপী মানুষ। ছোট্ট এই জীবদ্দশায় অসংখ্য জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষাই হয়তো অভিনয়ের নেশা ধরায়। অপরকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে করতেই একজন সাধারণ মানুষকে পেশাদার দক্ষ অভিনেতা বানিয়ে তোলে। সিনেমার বিশেষ কোনো চরিত্র, তার আচার-ব্যবহার, চিন্তাভাবনা, তার কথামালা, এমনকি তার না-বলা কথাগুলোরও ইঙ্গিত অভিনেতাকে পাঠ নিতে হয় দিনানুদৈনিক অসংখ্য চরিত্রের কাছ থেকেই। একে আমরা বলতে পারি জীবনের শিক্ষা। আয়নার সামনে আমরা নিজেকে সাজিয়ে নিই অন্যের নজর কাড়তে, পর্দার অভিনয়টা চলে দর্শকের মনের আয়নায় ঠাঁই নিতে।

জয়া আহসান দর্শকের মন জয় করেছেন তাঁর মননশীল অভিনয়গুণে। কী এই মননশীলতা? জগৎ-সংসারটা প্রাণভরে দেখা—দেখার অবসর, সঙ্গে দেখার চোখ। শিশুর মতো কৌতূহলী হয়ে দেখা, মন দিয়ে দেখা। মনের চোখ, যা কল্পনার বিস্তার ঘটায়। তারপর সেটা যত্নভরে, ধৈর্য ধরে হয়ে ওঠার চর্চা। ব্যাপারটা প্রায়োগিক। অপরের চরিত্রটুকু নিজের শরীরে জায়গা করে দেওয়ার কাজটা সহজ নয়। তার জন্য মনটাকে প্রসারিত করার মতো ঔদার্য থাকা ভীষণ জরুরি। নিজেকে শূন্য করে অপরকে পূর্ণ হতে আমন্ত্রণ জানানোর কাজটুকু প্রার্থনার শামিল বলেই গণ্য করি। জয়া আহসান অভিনয়টাকে সেইরূপে বিবেচনা করেন বলেই প্রত্যয় হয়।
এলাম-দেখলাম-জয় করলাম—এমনটা শিল্পী জয়ার বেলায় ঘটেনি। হয়তো কারও বেলায়ই সেটা এক দিনে ঘটে না। ধীরে ধীরে রপ্ত করতে হয়। জয়াকেও তাঁর নিজস্ব মাধুর্যটুকু পরখ করে, পরীক্ষা করে করে আজকের অভিনয়শিল্পীতে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। ব্যাপারটা যে এক দীর্ঘ অভিযাত্রীর—শিল্পী নিজেও তা মানবেন এই আন্দাজ থেকে। কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বলছি।
জয়া কেমন অভিনেত্রী? কিংবা ভালো অভিনয়ই-বা আমরা কাকে বলব? একজন মানুষ কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন? অপরের চরিত্রে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে কী কী গুণ থাকা চাই একজন অভিনেতার? প্রশ্নগুলোর সরল কোনো উত্তর জানা নেই আমার। বরং একজন গুণী শিল্পীকে সামনে রেখে নিজের কৌতূহলগুলোই আপনাদের সঙ্গে ভাগ করছি।
একের শরীর-মন থেকে বের হয়ে কিংবা আড়াল করে অপর আরেকজনের চরিত্রে প্রবেশ এবং বের হওয়ার ব্যাপারটা বরাবরই রহস্যজনক। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে নানা নির্দেশনা বা পর্দার সামনে বসে অভিনয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতির চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়তো আমরা করতে পারি, কিন্তু একটি অ্যাকশন ও কাটের মাঝের ওই বিশেষ মুহূর্তটি—ওই মাহেন্দ্রক্ষণটি সবার আগে অনুভব করেন অভিনয়শিল্পী! জগৎ-সংসারের সব যোগসূত্র মুলতবি রেখে, আপাতত ওই অলৌকিক মুহূর্তটি ধরা যাবে কি না, তা টের পান একজন প্রকৃত শিল্পী। জয়া আহসান আমাদের সময়ের তেমন একজন শিল্পী।

পরিচালক আমাকে যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই করেছি—এই আরামদায়ক অবস্থা এড়িয়ে অভিনয় আর চরিত্রটি নিয়ে নানা প্রশ্ন করে করে বিরক্ত করে তুলতেও জয়া আহসানকে দেখেছি। জটিল সংসারধর্ম পালনের পর শিশুর সারল্য নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র রচনা একটি দুর্লভ ঘটনা। আর তা যদি চলচ্চিত্রের মতো একটি কারিগরি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হাজারো অনুষঙ্গের ভেতর দিয়ে যায়, তাহলে তো বলাই বাহুল্য। তার সঙ্গে দরকার বিশাল ইউনিটের মধ্যে একটি অদৃশ্য ইউনিটি। পুরো ব্যাপারটির মধ্যে কোথাও যদি মনোযোগের এতটুকু অভাব ঘটে, ছন্দপতন ঘটে, আখেরে তা মাটি হতে বাধ্য। ধারণা করি, শুধু জয়া আহসান ভালো অভিনয় করেছেন—একটি সিনেমা দেখে কেউ যদি মন্তব্য করে, আমি আন্দাজ করি, কাজটি তার ভালো লাগেনি। মানে সিনেমাটি দর্শকের অন্তর ছুঁয়ে যায়নি। যখন দেহ আর আত্মা একাকার, তখনই তা প্রাণবন্ত! নইলে মুখ আর মুখোশের ব্যবধানটুকু রয়েই যায়। তখন অভিনীত চরিত্রের চরিত্রায়ণের মাধুর্যটুকু হারায়। এই বিবেচনা শিল্পী জয়া আহসানের আছে।

অভিনয় ব্যাপারটিতে একটি গল্পকাহিনির সাপেক্ষে নির্দিষ্ট চরিত্র চরিত্রায়ণে ওই চারুবাসনাটুকু বরাবর মনে রেখেছেন জয়া। এটা তাঁর প্রকল্প নির্বাচনের পর থেকে পুরো প্রক্রিয়ায় সংলগ্ন থাকার অভিপ্রায়ে স্পষ্ট। নানা চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগটুকু খুঁজে নিতে চেয়েছেন বলেই সুন্দর মুখের জয়া আহসান নায়িকা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বসে না থেকে অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনায় মনোযোগী হতে চেয়েছেন। পরিশ্রমী কর্মীর ভূমিকায় হাজির হয়েছেন। নিজেকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিয়েছেন। ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাকে ভয় না করে বরং আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নির্মাণের আনন্দযজ্ঞে হাজির হতে চাওয়া একেবারে তরুণতর নির্মাতার কাজটুকুতেও। আর অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন বলে আন্দাজ করি।

কিছু কাজ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর শিল্পীজীবনের একটি পরিক্রমা আঁকতে চাই। বলা বাহুল্য, এটা একেবারেই ব্যক্তিগত ভাষ্য। প্রায় দেড় যুগ আগে পলায়নপর্ব নামের একটি ছোট্ট ধারাবাহিকে জয়ার সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। অসম্ভব সুন্দরী একজন মডেলকে নাটকে অভিনয়ের জন্য ওই সময় কী অসীম ধৈর্য আর পরিশ্রম নিয়ে হাজির থাকতে দেখলাম। এরপর অনিমেষ আইচের হাটকুঁড়ায়, মেজবাউর রহমান সুমনের আঙুরলতায় তাঁর অভিনয়-কুশলতায় মুগ্ধতা এসে হাজির হলো। তারপর জাল, মনে মনে, দালিয়া, না কমলা না মেহেরজান—এই সব কাজ করতে করতে তাঁর সঙ্গে আমাদের একধরনের বোঝাপড়া। স্বপ্ন-স্মৃতি-সিনেমার ডুবসাঁতারডুবসাঁতার-এর রেণু এরপর সাহসী গেরিলা হয়ে উঠেছেন। আর্ট আর ইন্ডাস্ট্রির দোলাচালের শিল্পে নিজেকে পরখ করে দেখতে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী পরখ করা হয়ে গেল। তারপর বাংলা ভাষার ভৌগোলিক আবর্ত ভেঙে রাজকাহিনী, ভালোবাসার শহর-এ এক অনবদ্য অভিনয়শিল্পীর বিকাশ স্পষ্ট হতে দেখি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিসর্জন-এর অর্জন একজন পরিপূর্ণ অভিনেত্রী জয়া আহসান।

অনেক দিন আগে জয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছা করে? নারী-পুরুষ-হিজড়া, পরি কিংবা বুড়ি—যে চরিত্রেই তিনি অভিনয় করুন না কেন, আমাদের নির্মাতা-দর্শক অনেকের মধ্যেই তাঁর প্রতি একটা ভরসা দাঁড়িয়ে গেছে—জয়া কিছু একটা করবেনই। ভালো কিছু একটা করার জন্য জেদকে শক্তিতে রূপান্তরের কারিগর জয়া।

তাঁর সিনেমা নিয়ে ভাবনা, অভিনয় নিয়ে দীর্ঘ ও ধারাবাহিক প্রস্তুতি আর পেশাদারি মনোভাব এ সময়ের একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। সিনেমার অন্ধকার পর্দায় আলো ফোটানোর আকাঙ্ক্ষার অভিযাত্রী এই শিল্পী। শুধু অভিনয় করে, পুরস্কৃত হয়েই তৃপ্ত থাকার মানুষ নন জয়া। সিনেমার জন্য, সহযাত্রীদের জন্য তাঁর দরদি মনের খোঁজটুকুও স্পষ্ট করেন ভাববিনিময়ে, সাক্ষাৎকারে, ভাষ্যরচনায়। ২০১৭ সালের প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত একটি ব্যক্তিগত রচনায় তাঁর বিশেষ মনোভঙ্গির খোঁজটুকু পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছি যে তাঁর বিবেচনাবোধ বিবিধ অর্জনের ভারে এখনো ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। এ দেশের সিনেমার জন্য তাঁর অশেষ ভালোবাসা।

শুভকামনার এই পরিসরে তবু বলতে চাই, পায়ে পায়ে যতটুকু পথ তিনি রচনা করেছেন, আমাদের জন্য তা এখনো খুব সামান্যই। অনেক পথ হাঁটা এখনো বাকি। পথটা যে অনেক দূরের। নিরন্তর চলতে থাকুক তাঁর এই সৃষ্টিযাত্রা। আমৃত্যু, আজীবন!

পাঠক, আপনাকে সেলাম।

নূরুল আলম আতিক: চলচ্চিত্রনির্মাতা।