বিশ্বসভায় বাংলার শিক্ষক

বগুড়ার শেরপুরে শিক্ষক শাহনাজ পারভীন তাঁর শিশু-শ্রেণিকক্ষে। ছবি: সোয়েল রানা
বগুড়ার শেরপুরে শিক্ষক শাহনাজ পারভীন তাঁর শিশু-শ্রেণিকক্ষে। ছবি: সোয়েল রানা

‘খুকুমণি স্কুলে যায়/ নতুন বই হাতে/ ছোট খোকা পাছ লেগেছে/ যাবে তার সাথে/ হাঁটি হাঁটি পা পা করে/ খোকা চলে হেঁটে।’ ২০১৪ সালে প্রকাশিত ছড়ার বই পাখির মুখে ফুলের হাসির একটি ছড়ায় এভাবেই প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে নিজের ভাবনা ছন্দোবদ্ধ করেছেন শাহনাজ পারভীন। শিশু-কিশোরদের শিক্ষা নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী কাজের জন্য ইউনেসকোর মনোনয়নে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের বিশ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে সেরা পঞ্চাশের ‘গ্লোবাল টিচার পুরস্কার’ অর্জন করেছিলেন এই শিক্ষক। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ভারকি ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ২০১৭-এর ১৯ মার্চ এ পুরস্কার পাওয়ার আগে ২০০৯-১০ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী শিক্ষক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও পুরস্কার গ্রহণ করেন।
শাহনাজ পারভীন কাজ করছেন দুই ধারায়। একদিকে শেরপুর আদর্শ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নতুন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগে কাজ করেছেন, অন্যদিকে নিজের প্রতিষ্ঠিত শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত দুই শতাধিক শিশুকে শিক্ষা দিচ্ছেন।
কী এমন জাদু আছে শাহনাজ পারভীনের শিক্ষাচিন্তায়, তার সন্ধান পেতে তো শুরু থেকেই জানা দরকার তাঁর জীবনের গল্পটা। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষক। মা স্কুলে যাওয়ার সময় ছোট শাহনাজকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। বাড়িতেও ছাত্রছাত্রীরা আসত। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার ব্যাপার-স্যাপার তাঁর মনে প্রবল আকর্ষণ তৈরি করত। নিঝুম দুপুরে বাড়ির উঠোনে ‘স্কুল-স্কুল’ খেলতেন। একই সঙ্গে অভিনয় করতেন ছাত্র ও শিক্ষকের ভূমিকায়। ঘটনাচক্রে অল্প বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাঁকে। কিন্তু বাবা-মায়ের দিক থেকে শ্বশুরবাড়ির প্রতি শর্ত ছিল, বিয়ের পরও মেয়েকে পড়াশোনা করতে দিতে হবে। শ্বশুরালয়ে গিয়ে শাহনাজ প্রথমেই ছোট ননদদের পড়াশোনা করানোর ব্যবস্থা করেন। শুরু থেকেই চেয়েছেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে। সপ্তম শ্রেণিতে একটি প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন বেগম রোকেয়ার বই। রোকেয়া পড়ে তাঁর আদর্শে সব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে শিক্ষার আলোয় নিজেকে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হন।
১৯৯৮ সালে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে পড়ার সময়ই শাহনাজ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একটি স্কুল খুলেছিলেন। শিক্ষা নিয়ে এটিই তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৩-এ সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকটা তাঁর জীবনে মোড় ফেরানো স্মৃতি হয়ে রয়েছে।
স্কুলের যে কক্ষটিতে বসে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম, সেখানেই তাঁর নেওয়া ক্লাস পরিদর্শন করতে এসেছিলেন স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা। সেদিন কী এক অজানা উৎকণ্ঠায় তিনি ভালোভাবে ক্লাস নিতে পারেননি। তাঁর মা শিক্ষিকা নূরজাহান বেগমও ছিলেন পরিদর্শক দলে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে তিনি হতাশা জানালেন মেয়ের কাজে। মা সমালোচনা যেমন করলেন, তেমনি এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন নির্দেশনা।
বললেন, ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্যবই মুখস্থ করার চেয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা বেশি পছন্দ করে, এ জন্য শিক্ষা উপকরণ তৈরি করা জরুরি। উলিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত সাবেক শিক্ষক তাঁর মা এবং নাজির উদ্দিন স্যারের অবদান এই পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ছিল শাহনাজের জীবনে। তাঁর মা নূরজাহান বেগম জানালেন, ছোটবেলা থেকেই শাহনাজ পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। তা ছাড়া তিনি চেয়েছিলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর সন্তানেরা যেন সমাজসেবায়ও এগিয়ে থাকে।
শিক্ষকতায় আরও দক্ষতা অর্জনের জন্য শাহনাজ এরপর ভর্তি হলেন পিটিআই কোর্সে। সেখানে কয়েকজন শিক্ষকের ক্লাস শুনে মুগ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবলেন, তিনিও একদিন এমন ক্লাস উপহার দেবেন, যে ক্লাসে ছাত্ররা থেকে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকবে। তিনি শ্রেণিকক্ষনির্ভর পাঠদানের পদ্ধতি বদলে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
কথায় কথায় শাহনাজ জানালেন, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিলগ্ন ব্যতিক্রমী শিক্ষাভাবনার ছবি কোথাও তিনি দেখেছিলেন, যা তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে। উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রমে মনোবিজ্ঞান ছিল শাহনাজ পারভীনের। শিশু-মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়তে গিয়ে বুঝেছেন, বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গে পড়তে চায়। তাই পড়ার ফাঁকে কখনো গান গেয়ে, কখনো খেলার আয়োজন করে শিশু-কিশোরদের পাঠে নিবিষ্ট করার দিকে মূল মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন শাহনাজ। তার সঙ্গে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস। প্রজেক্টরে বাংলাদেশ নিয়ে তথ্য চিত্তাকর্ষক করে দেখানো। এসব ক্লাসের আকর্ষণে শিশু-কিশোরেরা ছুটে আসত, যারা ক্লাসে আসত না তাদেরও ক্লাসে আসতে অনুপ্রাণিত করত।
প্রথম প্রথম অভিভাবকেরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে খোলা মাঠে পাঠদান অথবা ক্লাসের সময় গান গাওয়া বা খেলাধুলার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। কোনো কোনো অভিভাবক স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও নিয়ে আসতেন। কিন্তু যখন দেখা গেল এসব শিশু-কিশোর পরীক্ষায় ভালো ফল করছে, তখন সবাই দৃষ্টান্ত হিসেবে নিল তাঁর ক্লাসকে। শিক্ষা থেকে ঝরে পড়াও নেমে এল। উপজেলা পর্যায়ে সেরা শিক্ষকের স্বীকৃতি পেলেন শাহনাজ। তাঁর শিক্ষাবিষয়ক লেখালেখি, শিক্ষা উপকরণ তৈরি ইত্যাদি একজন সেরা শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হলো।
জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়ার পর ২০১৫ সালে শাহনাজ গিয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়া সফরে। সেখানকার বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখেছেন, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক একেবারেই সন্তান ও বাবা-মায়ের মতো। ভীতি মুছে দিয়ে সহজ ও আন্তরিক সম্পর্কই শিক্ষাকে ফলদায়ী করতে পারে। সে-ই ধারণাই এখনো মেনে চলার চেষ্টা করেন তিনি। তাঁর বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অন্তরা খাতুন যেমন বলল, ম্যাডামের পড়ানোটা দারুণ। একেবারে মায়ের মতো মমতায় সবকিছু বুঝিয়ে দেন। বাসায় গিয়ে আর বিশেষ পড়তে হয় না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস এম গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘শাহনাজের নিত্যনতুন শিক্ষা উপকরণ ও ছাত্রছাত্রীদের হাতে-কলমে শিক্ষাদানের পদ্ধতি দেশ ছাপিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে যেভাবে প্রশংসিত হয়েছে, তাতে আমরা গর্বিত।’
শাহনাজ পারভীনের গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু যিনি মনে করেন প্রকৃত শিক্ষকের কোনো অবসর নেই, তিনি তো এখানেই থেমে থাকতে পারেন না। ২০১৩ সালে তিনি শুরু করলেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান কার্যক্রম। নিজের মেয়েদের যখন তিনি স্কুলে নিয়ে যেতেন, তখন দেখতেন ছিন্নমূল শিশুরা তাঁদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। একদিন শামীম নামে লেদ মেশিনে কাজ করা এক কিশোরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, সে পড়তে চায়। শাহনাজ তার মালিকের বাসায় গিয়ে বললেন, কাজের ফাঁকে তিনি শামীমকে পড়াতে চান। প্রথমে রাজি না হলেও পরে বুঝিয়ে মালিককে রাজি করানো গেল। শামীম ও সাদমান নামে দুই ছাত্র নিয়ে শুরু হলো তাঁর নতুন শিক্ষা কার্যক্রম। তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোর ছাত্রছাত্রী সংগ্রহের জন্য। প্রথমে তেমন সহযোগিতা পাননি। ধীরে ধীরে যখন দেখা গেল এসব শিশু-কিশোরের ভেতর পরিবর্তন আসছে, তখন অনেকেই বাড়ির কাজের ছেলেমেয়েকে নিয়ে এলেন তাঁর কাছে। ২০১৫ সালে শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এখানকার শিক্ষার ধরন আর দশটা বিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন। ছিন্নমূল শিশুদের কাজের দিকে খেয়াল রেখে বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে পাঠদান। শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে বই-খাতা-কলম-স্কুলব্যাগসহ সব শিক্ষা উপকরণ আর টিফিন পায়। দৈনিক পত্রিকা পড়ে শিক্ষকেরা দেশ-বিদেশের প্রধান প্রধান ঘটনা তাদের বুঝিয়ে বলেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য এখানে রয়েছে বিশেষ কার্যক্রম। এসব কাজে শাহনাজের দুই মেয়ে মাসুমা মরিয়ম আর আমেনা মুমতারিনও সহযোগিতা করে মাকে। ১১ জন অটিস্টিক শিশুকে শাহনাজের ফিজিওথেরাপিস্ট বোন দেখাশোনা করেন। তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সেবাসামগ্রী দেওয়া হয় বিনা মূল্যে। এ বছর স্কুলটি সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে উচ্চবিদ্যালয়ের কার্যক্রম। অদূর ভবিষ্যতে একে কলেজে রূপান্তরেরও স্বপ্ন আছে শাহনাজের।
শাহনাজকে অনেকেই বলেছেন, বগুড়ার প্রত্যন্ত জায়গায় বসে না থেকে ঢাকায় গিয়ে ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কিছু করলে সরকারি সহায়তাসহ এনজিওর কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাবে। কিন্তু কঠিনেরে ভালোবাসিলেন শাহনাজ। ঢাকায় তো অনেকেই আছে। নিজের কাজের জন্য প্রান্তবর্তী এই অঞ্চলটিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
গত ১৭ অক্টোবর ২০১৭ বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার সদরে টাউন কলোনি-শান্তিনগরে তাঁর বাড়িসংলগ্ন শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল অপূর্ব দৃশ্য। জায়গা অপরিসর, কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। শ্রেণিকক্ষগুলো শাহনাজ পারভীনের উদ্ভাবনায় বর্ণিল। শ্রেণিকক্ষের নাম দেওয়া হয়েছে তিন কবির নামে—রবীন্দ্র কক্ষ, নজরুল কক্ষ, জসীমউদ্দীন কক্ষ। দেয়ালে দেয়ালে উদ্ভিদ ও প্রাণিবিশ্ব, ঋতুবৈচিত্র্য, মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, বেগম রোকেয়া আর মাদার তেরেসার ছবি। আঁকা আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বার্তা। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্যও বার্তা আছে, ‘আমি কি যথাসময়ে ক্লাসে ঢুকেছি’, ‘ক্লাসের সময় আমি অফিসে কেন’, ‘আমি কি পূর্বদিনের পড়া আলোচনা করেছি’, ‘আমি কি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) শিশুদের প্রতি মনোযোগ দিয়েছি?’
২০১৭-এর ১৯ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বিশ্বের সেরা পঞ্চাশ শিক্ষকের একজন মনোনীত হয়ে সনদ গ্রহণের মুহূর্তটি ভোলেননি শাহনাজ। তিনি বললেন, ‘সনদটি নিতে গিয়ে ভাবছিলাম সেই শুরুর দিনগুলোর কথা। ভাবছিলাম লেদ মেশিন শ্রমিক শামীমের কথা বা অটিস্টিক কোনো শিশুর কথা, যাদের চোখে-মুখে ছিল লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা। আমি শুধু তাদের ইচ্ছাটুকু পূরণে সহায়তা করেছি। দেশের সব সুবিধাবঞ্চিত শিশু শিক্ষার সুযোগ পেলেই না আমরা আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।’ যে স্কুলঘরে কথা হচ্ছিল, শাহনাজের স্বপ্নের আভাস হয়েই যেন তার বাইরে এসে পড়েছে উজ্জ্বল রোদেলা আলো।
পিয়াস মজিদ: কবি।