এগিয়ে চলার সাহস

>

ভয়কে জয়ের সাহস আছে তাঁদের, তাঁরা অদম্য। বাঁধা পেরোনো অদম্য মেধাবীর গল্প

সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সামনে মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সামনে মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম। ছবি: আনিস মাহমুদ

মোহাম্মদ শামসুল হক। জন্মগতভাবে ঠোঁট কাটা। বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার হবে বলে কিশোর বয়সে তাঁকে ভর্তি করানো হয় সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২০০৪ সালের কথা। বয়স তখন তাঁর ১০। চিকিৎসকদের ব্যবহারে এমনই মুগ্ধ হলেন শামসুল, হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে মনে মনে সংকল্প করলেন, ‘পড়াশোনা করতে পারলে ভালোভাবেই করব। ডাক্তার হব একদিন।’
সেই কিশোরের স্বপ্ন সত্যি হবে কি না, সে আশা তো দূরের কথা, তাঁর পড়াশোনাই ঠিকমতো চলবে কি না, সেটিও জোরের সঙ্গে কোনো দিন ভাবতে পারেননি শামসুলের মা-বাবা। একে তো ঠোঁট কাটা, তার ওপর প্রচণ্ড টানাপোড়েনের পরিবার—ভালো পড়াশোনা করে ছেলে একদিন চিকিৎসক হবেন, এমন স্বপ্ন দেখা তো তাঁদের জন্য রূপকথার গল্প। সেই স্বপ্নের পথ খানিকটা খুলে গেল ২০১০ সালে যখন শামসুল মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেলেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ জোগাবেন কী করে? কৃষক পরিবারে খেয়েদেয়ে দিন পার করাই তো দুষ্কর! শামসুলের ভাষায়, তখন ত্রাতা হয়ে এল প্রথম আলো। প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবীর বৃত্তি পেলেন তিনি। এরপর সিলেট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকেও একই ফল।
২০১৩ সালে ৫২তম ব্যাচে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন শামসুল। এখন শেষ বর্ষে। প্রথম আলো ট্রাস্ট মেধাবৃত্তি অব্যাহত রেখেছে তাঁর। আপ্লুত শামসুল বলেন, ‘পেছনের সবকিছু এখন স্বপ্নে মতো মনে হয়।’
শামসুলের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার পশ্চিম শ্বাসরাম গ্রামে। বাবা কৃষক নুরুল হক বর্গাচাষি। মা গুলনেহার গৃহিণী। পাঁচ বোনের পর শামসুল সবার ছোট। ঠোঁট কাটা থাকায় ছেলে বড় হয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে ছিলেন নুরুল-গুলনেহার দম্পতি। ভিটেমাটি ছাড়া তেমন জায়গাজমিও নেই, যা বিক্রি করে ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা করাবেন। পরের জমিতে বর্গা চাষ করে যা পান, তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে তাঁদের। শুরুতে স্কুলে ভর্তি করারও সাহস পাননি। তাঁদের দুশ্চিন্তার কথা জেনে শ্বাসরাম রহমান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদ নিজের উদ্যোগে শামসুলকে নিয়ে গেলেন স্কুলে।
বড় বোন রশিদা বেগম ও মাজিদা বেগমের সঙ্গে স্কুলে যেতেন শামসুল। মুখে কোনো কথা না থাকলেও পড়াশোনায় ছিলেন বেশ মনোযোগী। প্রাথমিকের প্রতিটি স্তরে প্রথম স্থান নিজের দখলেই থাকল তাঁর। এর ফলেই বিদ্যালয়ে প্রথম বৃত্তি এল তাঁর কাছে। আরও পরে ২০১০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পেয়ে গেলেন জিপিএ-৫।
২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে ভর্তি হওয়ার আর্থিক সমর্থ্য না থাকায় ভর্তি হলেন সিলেট এমসি কলেজে। পরের বছর ২০১৩ সালে আবারও পরীক্ষা দিয়ে তিনি পেয়ে গেলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ।
ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আজও তিনি কৃতজ্ঞ শ্বাসরাম রহমান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদের কাছে। এরপর তাঁর কৃতজ্ঞতা বড় বোন ফাহমিদা বেগমের কাছে, যাঁর কাছে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। আর মা-বাবা ও প্রথম আলো ট্রাস্ট, যাদের মাধ্যমে তাঁর এত দূর আসা। প্রথম আলো ট্রাস্টের পাশাপাশি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকেও পাচ্ছেন মেধাবৃত্তি।
ঠোঁট কাটার জন্য এ পর্যন্ত পাঁচবার অস্ত্রোপচার হয়েছে শামসুলের। এ সমস্যার কারণে প্রথমে কথা বলতে পারতেন না। এখন মোটামুটি পারেন।
এক বছর পর শামসুলের কাছে চলে আসবে এমবিবিএস ডিগ্রি। এরপর তো স্বপ্ন একেবারে হাতের মুঠোয়। তবে চিকিৎসক হিসেবে অল্পস্বল্প যাত্রা তাঁর শুরুও হয়ে গেছে। সিলেটের বিশ্বনাথে বাড়ি হওয়ায় এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেকেই শামসুলকে ফোন করে চিকিৎসা-সংক্রান্ত সহায়তা চায়।
মেডিকেল কলেজেই শামসুলের সঙ্গে কথা হলো। পরিপাটি পোশাক, পরনে অ্যাপ্রোন, হাতে স্টেথিস্কোপ। ফেলে আসা সময়ের কথা উঠতেই শামসুল আপ্লুত। বলেন, ‘ঠোঁটটি কাটা বলে অনেকেই আমাকে অবহেলা করত। তবে সেসব অবহেলা আর বিদ্রূপই আমাকে স্বপ্নের পথে হাঁটার জন্য সাহসী করেছে।’
উজ্জ্বল মেহেদী: সাংবাদিক।

প্রথম আলো ট্রাস্ট
অদম্য মেধাবী তহবিল
শিক্ষাবৃত্তির সূচনা
২০০৭
ব্র্যাক ব্যাংকের সম্পৃক্ততা
২০১০ থেকে
অন্যান্য সহযোগী
ট্রান্সকম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, আমেরিকান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, দুবাই–প্রবাসী ব্যাংকার গ্রুপ এবং রুমানা আহেমদ, ফাইজা রহমান, মাহবুবুল হক, িমতুলী মাহবুব, ফজলে এলাহী, মাসুদ উল আলম ও সারা অ্যান্ড জেমী শার্লিবয়েস
বৃত্তিপ্রাপ্ত মোট শিক্ষার্থী
৭৪১
বর্তমানে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী
৩১৬