ধানবীজের রূপকথা

>

তাঁরা সফল হয়েছেন কৃষিতে, তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় দেশও পেয়েছে সাফল্য। দুই সফল কৃষকের কাহিনি

দুর্লভ ধানবীজ হাতে রাজশাহীর কৃষক ইউসুফ মোল্লা। ছবি: শহীদুল ইসলাম
দুর্লভ ধানবীজ হাতে রাজশাহীর কৃষক ইউসুফ মোল্লা। ছবি: শহীদুল ইসলাম

ধানের নাম রূপকথা। গল্পটাও রূপকথারই মতো। ইউসুফ মোল্লা ছিলেন সাধারণ চাষি। কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় দেশি জাতের ধানের বীজের সংগ্রহে তিনিই গড়ে তুলেছেন ‘বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক’। আর এই বীজভান্ডারে জমা করেছেন ২০০ জাতের দেশি ধানের বীজ। এই বীজগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে দেশের ১১টি জেলায় চলতি আমন মৌসুমে ৯৪ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে।
জিন ব্যাংকে সংরক্ষণের জন্য ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট তাঁর কাছ থেকেই নিয়ে গেছে ১০০টির বেশি জাতের বীজ। এ বছরের অক্টোবরে তাঁর ধানের ছয়টি জাত নিয়ে শ্রীলঙ্কায় একটি সেমিনারে যোগ দিয়েছে পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক)। কৃষিতে এই অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০১৩’। এর আগে বৃক্ষরোপণের জন্য ২০০৬ সালে খামারবাড়ি থেকেও একটি পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।
দেশি জাতের ধানের বীজ বাঁচানোর জন্য আকুল এই স্বশিক্ষিত মানুষটি ৫০ বছর ধরে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক না দিয়ে চাষ করা যায়, এমন খরাসহিষ্ণু জাতের ধানের চাষ তিনি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চান। এ জন্য চাষিদের বীজ দেন বিনা মূল্যে। শর্ত একটাই, চাষ করে তাঁকে দ্বিগুণ পরিমাণ বীজ ফেরত দিতে হবে। কারণ, সেই বীজ আবার নতুন চাষিদের মধ্যে বিতরণ করবেন তিনি। শুধু কি এ-ই? এসব ধানের চাল দিয়ে বিচিত্র খাবার বানিয়ে নবান্ন উৎসব করেন নিজের গ্রামে। বিলুপ্তপ্রায় ধান নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন সেই উৎসবে।
ইউসুফ মোল্লার বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামে। বাবা আবদুর রহমান মালাকারও ছিলেন আদর্শ চাষি। ছোটবেলায় বাবাকে এসব ধানের চাষ করতে দেখেছেন। বেশি ভাইবোনের সংসারে অষ্টম শ্রেণির পর লেখাপড়া এগোয়নি। তাই বাবার সঙ্গে শুরু করেছিলেন কৃষিকাজ।
দুবইল গ্রামে ঢুকতেই রাস্তার মোড়ে চোখে পড়ে ‘বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। এর আধা পাকা ঘরে কাচের বয়ামে বয়ামে সাজানো রয়েছে ধানের বীজ। ইউসুফ মোল্লার স্মৃতিশক্তি প্রখর। একেকটি ধানের বীজের বয়াম হাতে নিয়ে তার বৈশিষ্ট্য বলে যান গড়গড় করে। কোন ধান কোথায় কখন খুঁজে পেয়েছেন, তার স্মৃতিও জ্বলজ্বলে।
কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির অতলে চলে যান ইউসুফ মোল্লা। ১৩৩৪ বাংলা সনে বড় মঙ্গা হয়েছিল। সে সময় তানোরের কোয়েল গ্রামের আনিস মাস্টারের বাবা একজন হিন্দু গৃহস্থের কাছ থেকে কর্জ করে কিছু ‘সোনাকাঠি’ ধান নিয়েছিলেন। ভাঙানোর আগে আনিস মাস্টারের মা খানিকটা ধান মাটির হাঁড়িতে রেখে মাটি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেন। সংরক্ষণের জন্য ধান রাখলে কিছুদিন পরপর রোদেও দিতে হয়। এই ধানের খবর পেয়ে ইউসুফ মোল্লা আনিস মাস্টারের কাছে গিয়েছিলেন। আনিস মাস্টার বাড়ির পুরোনো জিনিসপত্রের ভেতর থেকে সেই হাঁড়ি উদ্ধার করে সোনাকাঠি ধানের বীজ তাঁকে উপহার দেন। ওই বীজ এখনো তাঁর কাছে অবিকল রয়েছে।
বিলুপ্তপ্রায় ধানের বীজের খবর পেলেই পাগলের মতো ছুটে যান ইউসুফ মোল্লা। এভাবেই তিনি পেয়েছেন গাইবান্ধায় সভারাজ; সাতক্ষীরার শ্যামনগরে দুই সতিন, মালতি, নারকেলবাঁধা (আমড়াঝুলি), গোহরিমোটা, লালচিকন ও তালমুগুর; নেত্রকোনায় কালোবিন্নি, জলডোবা ও কাকুরি; ময়মনসিংহের বেনুয়ার চরে সাদাঢেপা; দিনাজপুরের কাহারুল থেকে নারিপারিজাত ও কালোবকরি; বরিশালে বালাম ধানের সন্ধান।
ধানের বৈশিষ্ট্যের যেন তিনি এক বিশ্বকোষ। বালাম ধানের রং সাদা। চাল সরু, রং লাল। দুই সতিন ধানের একটি বীজে দুটি সরু দানা। ভালো মুড়ি হয় চিনিশঙ্কর, অহনা, চেঙ্গুর ও ঝিঙাশাইল ধানে।
৫২ শতাংশ জমিতে তিনি ৫২ জাতের ধান চাষ করেছেন। খেতে গিয়ে দেখা গেল, কোনো কোনো জাতের ধানে শিষ বেরিয়েছে। কোনোটির বের হবে হবে। প্রতিটি জাতের নাম লিখে সাইনবোর্ড দেওয়া। এই খেতেরই একটি ধানের নাম রূপকথা। আরও কত অপরূপ নাম। জামাইনাড়ু, চিনিশঙ্কর, রাঁধুনি পাগল, দাদখানি, সুমনস্বর্ণা, পাঙাশ, কালোজিরা, আমানিয়া, গোবিন্দভোগ, সোদামোটা।
ইউসুফ মোল্লা বিয়ে করেছিলেন ১৯৬৮ সালে। তার বছরখানেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে ইরি-৮ ধানের আবাদ। তার প্রকোপে এলাকার মানুষ ঐতিহ্যবাহী দেশি ধানের আবাদ ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। তখনই তাঁর শঙ্কা হলো, একটা সময় হয়তো আসবে, যখন এসব নানা জাতের ধানের বীজ আর পাওয়া যাবে না। সেই থেকে তিনি ধানের বীজ সংরক্ষণের পণ করলেন। প্রথমে মাটির হাঁড়িতে, আরও পরে কাচের বয়ামে।
গাজীপুরের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৎকালীন বৈজ্ঞানিক সহকারী জহুরুল হকের কাছে জানা গেল, জিন ব্যাংকে সংরক্ষণের জন্য গত বছর ১০০ জাতেরও বেশি ধানের বীজ তাঁরা এনেছেন ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে। তাঁদের মাঠে সেসব পরীক্ষা হচ্ছে। অনেক দিন আগের বীজ বলে সবগুলোয় হয়তো অঙ্কুর হবে না।
বারসিক তানোর শাখার সহযোগী কর্মসূচি কর্মকর্তা অমৃত সরকার বললেন, ইউসুফ মোল্লার উদ্যোগ আরও বেগবান করার জন্য তাঁরা সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। ইউসুফ মোল্লার ধানবীজের তালিকা তাঁদের কাছে রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, তাঁর সংগৃহীত ধানবীজের ১০৮টি জাতের আর অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা নেই। সেসব সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রদর্শনের জন্য। অবশ্য এবারের আমন মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নীলফামারী, বগুড়া, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় তাঁর ৯৪টি জাত চাষ করা হয়েছে।
ইউসুফ মোল্লার তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত। মেয়ে নিজের সংসারে। এখন তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান দেশি ধান। ছেলেরা পাকা বাড়ি তুলেছেন। কিন্তু ইউসুফ মোল্লা ঘুমান তাঁর নিজ হাতে গড়া মাটির ঘরে। বয়সের ভারে বাড়িটি প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তবু তিনি বাড়ি ছাড়বেন না। বাড়ির ভেতরে ঢুকে এই মায়ার কারণ জানা গেল। ঘরে ঘরে সাজানো ড্রাম, বয়াম আর মাটির হাঁড়ি। তার ভেতরে গচ্ছিত বিরল জাতের ধান। বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকে জায়গা হচ্ছে না বলে বাড়িতে এনে রেখেছেন।
একটি ড্রাম খুলে ইউসুফ মোল্লা বের করলেন ‘উকুনমধু’ নামের ধানবীজ। ধানগুলো শিষের ছড়া ধরেই রাখা হয়েছে। ইউসুফ মোল্লা জানালেন, এই ধানের চালে পোলাও হয় দারুণ খোশবুদার। আরেকটি ড্রাম থেকে বের করলেন তাঁর পছন্দের ‘রাঁধুনি পাগল’। একটি ধান ছিঁড়ে হাতে দিয়ে বললেন, ‘পাঁচ বছর আগে রাখা ধান। কিন্তু ডলা দিয়ে দেখেন, কী সুগন্ধ! এর চালে পোলাও আর সাদা ভাত দুটোই চমৎকার।’
ইউসুফ মোল্লা এরই মধ্যে আরও কিছু জাত সংগ্রহ করেছেন। এখনো সেসব খাতায় তোলা হয়নি। বয়স এখন তাঁর ৭৬ বছর। ধান সংগ্রহে তাঁর আগ্রহ এখনো তরুণ বয়সের মতোই প্রবল।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ: প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি।