স্যানিটেশন: এক শতে শূন্য পাওয়ার আনন্দে

মাটির এমন রিং দিয়ে তৈরি হয় স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। ছবি: হাসান মাহমুদ
মাটির এমন রিং দিয়ে তৈরি হয় স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। ছবি: হাসান মাহমুদ

স্যানিটেশনে বাংলাদেশের সাফল্য সবার জানা, তবে তার পেছনের কাহিনি অনেকেরই বিস্তারিত জানা নেই। ২০১৫ সালে স্যানিটেশনে নিয়োজিত বাংলাদেশের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় স্যানিটেশন সচিবালয়ের ছত্রচ্ছায়ায় একত্র হয়ে একজন দেশি আর একজন বিদেশি গবেষক নিয়োগ করে বাংলাদেশের স্যানিটেশনের সাফল্যগাথার একটা বিস্তারিত বর্ণনা (ন্যারেটিভ) তৈরি করেন। এই নিবন্ধটি মূলত সেই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে রচিত।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশে স্যানিটারি ল্যাট্রিনের হার কত ছিল, তা এখন সঠিক অনুমান করা মুশকিল। বিশ্বব্যাংকের পানি ও স্যানিটেশন কর্মসূচি নির্ণয় করেছে যে সে সময়ে বাংলাদেশে স্যানিটেশনের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ। ইউনিসেফের নলকূপ বিপ্লবের পাশাপাশি আশির দশকে খাবার স্যালাইনের সফল প্রচলন ঘটিয়ে ডায়রিয়াজনিত মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে আনতে পারলেও স্যানিটারি ল্যাট্রিনের স্বল্প ব্যবহারের কারণে ডায়রিয়াজনিত রোগ ও অপুষ্টির ব্যাপকতা আনুপাতিক হারে কমেনি। নব্বই দশকের শুরুর দিকেও বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় পায়খানা করত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর ইউনিসেফ যৌথভাবে একটি কর্মসূচি পরিচালনা করে, যার নাম জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি)। জেএমপি পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সুপেয় পানি আর স্যানিটেশনের হার নিরূপণ করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০১৪ সালে জেএমপি হিসাব দেখাচ্ছিল যে বাংলাদেশে খোলা মাঠে পায়খানার হার মাত্র ৩ শতাংশ। সে সময় প্রতিবেশী ভারতে এই হার ছিল প্রায় ৪৮, নেপালে ৪৩ আর পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। চিন্তা করে দেখুন, ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষ খোলা মাঠে যাচ্ছে পায়খানার জন্য, তাদের অর্ধেক আবার নারী। নারীর সম্ভ্রম, অধিকার—এসব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্জনের কথা ভাবলে গর্ববোধ হতেই পারে। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই প্রকাশিত এসডিজির বেসলাইন প্রতিবেদনে জেএমপি জানিয়েছে যে বাংলাদেশে এখন খোলা জায়গায় পায়খানার হার শূন্যের কোঠায়। যে দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ খোলা মাঠে পায়খানার হার কমিয়ে আনতে পেরেছে তা পৃথিবীর খুব কম দেশেই ঘটেছে। সেই সঙ্গে আরও বিস্ময়কর যে বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যেও ল্যাট্রিনের ব্যবহার প্রতিবেশী সব দেশের চেয়ে বেশি।
সত্তর থেকে শুরু করে আশির দশকে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ স্যানিটারি ল্যাট্রিনকে জনপ্রিয় করার জন্য কখনো বিনা মূল্যে, কখনো স্বল্পমূল্যে জনগণকে ল্যাট্রিনের রিং স্ল্যাব সরবরাহ করেছে। এতে সাফল্য এসেছে সীমিত আকারে। নব্বই দশকে এসে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ইউনিসেফ এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা ও এনজিও বেশ জোরেশোরে নামে স্যানিটেশনকে এক দশকের মধ্যে শতভাগে উন্নীত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রতি উপজেলায় স্থাপন করে রিং স্ল্যাব বানানোর উৎপাদনকেন্দ্র। বড় বড় ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন: ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক তাদের সদস্যদের গৃহঋণের অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে থাকে ল্যাট্রিন বসানোর রিং স্ল্যাব। জোর করে যে মানুষের আচরণ বদলানো যায় না তা নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে। যেমন ল্যাট্রিনের রিং ব্যবহৃত হয়েছে মুরগির বাচ্চার চারণক্ষেত্র কিংবা গরুর খড় খাবার চাড়ি হিসেবে। নতুন বানানো ল্যাট্রিন ব্যবহৃত হয়নি নানা কুসংস্কারে। এসব প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে নব্বই দশকের শেষ দিকে এসে কিছুটা আলোর দিশা দেখা গেল যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট ছোট সাফল্যের কাহিনি আসতে শুরু করল। কলেরায় আক্রান্ত বানারীপাড়া, গৌরনদী, আগৈলঝাড়ার প্রত্যন্ত কয়েকটি ইউনিয়নে কিংবা সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম উপজেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্যোগে স্থানীয় জনসাধারণ প্রায় শতভাগ স্যানিটেশন করে কিছু অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি করে ফেললেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে রাজশাহী জেলার মসমইল গ্রামে তৈরি হলো আরেক যুগান্তকারী উদাহরণ। গ্রামের মানুষ সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে পুরো গ্রামের প্রতিটি ঘরে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলেন—এই গ্রামের কেউ খোলা মাঠে পায়খানা করে না। খোলা পায়খানার কুফলকে নানা প্রকার অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় ছবির মতো সামনে তুলে ধরে বিবমিষা জাগিয়ে গ্রামবাসীকে যূথবদ্ধ ও আত্মপ্রত্যয়ী করে গ্রামকে খোলা পায়খানামুক্ত করার এই প্রক্রিয়া ক্রমে পরিচিত হয় কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশন (সিএলটিএস) নামে, যা পরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে।

শতভাগ স্যানিটেশনে আত্মপ্রত্যয়ী স্থানীয় সরকার বিভাগ জাতীয় স্যানিটেশন সচিবালয় এবং একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করে প্রতিটি জেলা ও উপজেলার অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে থাকে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ এলাকায় খানা জরিপ করে স্যানিটেশনের অগ্রগতি যাচাই করতে শুরু করে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসকে জাতীয় স্যানিটেশন মাস হিসেবে উদ্‌যাপন করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সালতামামি আলোচনার একটি ধারা শুরু করা হয়। মন্ত্রণালয়, ডিপিএইচই, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন, মসজিদ, মন্দির কর্তৃপক্ষ সব পর্যায়ে শুরু হয় সচেতনতা ও পরিকল্পনা—ঘরে ঘরে ল্যাট্রিন হতে হবে। দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখতে পেয়ে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেন সরকার এগিয়ে আসে স্থানীয় সরকারের পাশে। প্রায় ৩০০ উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করার জন্য।
সরকারি প্রতিষ্ঠান, ডিপিএইচইর পাশাপাশি ইউনিসেফ, ব্র্যাক, ওয়াটারএইড, এনজিও ফোরাম, ভারক, ডিএসকেসহ নানা সংস্থা নিয়োজিত হয় স্যানিটেশনের সামাজিক আন্দোলনে। সিএলটিএস প্রক্রিয়ার মূলনীতি অটুট রেখে বেশির ভাগ এনজিও এর নানা প্রকার সংশোধিত ও উন্নত রূপ নিয়ে স্যানিটেশনকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করে। স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্দেশনা জারি করে যে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভাসহ সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ২০ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে স্যানিটেশনের জন্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবকাঠামো সাহায্য ও স্যানিটেশনের প্রচারাভিযানের জন্য।
বাংলাদেশের শিল্প খাত বিশেষত প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো চমৎকার উদ্ভাবনী ও বিপণনশক্তির ছাপ রেখেছে স্যানিটেশনের সাফল্যে। মাত্র ৬০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে প্লাস্টিক প্যান, ২০-৩০ টাকার মধ্যে ওয়াটারসিল বানিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজারজাত করে নিজেদের ব্যবসার পাশাপাশি মানুষের বিরাট উপকার করেছে। ওজনে হালকা, টেকসই এসব প্লাস্টিক স্যানিটেশন পণ্য বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্লাস্টিকের স্যানিটেশন পণ্য এখন বিদেশেও রপ্তানি হয়।
তবে শূন্য পাবার আনন্দে গর্বিত হলেও তুষ্ট-বিভোর হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। খোলা জায়গায় পায়খানার হার শূন্যে নামিয়ে আনা স্যানিটেশনের একটি ধাপ মাত্র। সংখ্যার পর এখন গুনগত মানোন্নয়নের পালা।

খোলা মাঠে পায়খানা

২০১৪ সালে ৩%
২০১৭ সালে


(নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব, সংস্থার নয়।)

মো. খায়রুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী, ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর।