জৈব কৃষি - এক নতুন বিপ্লবের নাম

ঝিনাইদহে জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষের একটি খেত। ছবি: আজাদ রহমান
ঝিনাইদহে জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষের একটি খেত। ছবি: আজাদ রহমান

‘ও ভাই খাঁটি, সোনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি’—কবির এই কথাটি বাংলাদেশের মাটির ক্ষেত্রে পরম সত্য। কারণ, গত এক যুগে আমাদের জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে, কিন্তু আমাদের মাটি এমনই উর্বর যে অকৃপণ হাতে ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে। এই উৎপাদনে কোথাও কোনো কমতি নেই। যেখানেই বীজ ছিটানো হয়, সেখানেই যেন সোনা ফলে। আধুনিক প্রযুক্তি, বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের নতুন নতুন গবেষণা আর আবিষ্কারে অধিক ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে। আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হচ্ছে, কৃষকও ভালো দাম পেয়ে খুশি হচ্ছেন। কিন্তু এতসব প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার পরও আমরা সবাই একটা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি, তা হলো বাজার থেকে যে ফসল আমরা কিনে আনছি, তা সম্পূর্ণ নিরাপদ তো!
অনেকেই আজকাল ‘বিষমুক্ত সবজি’ কথাটি ব্যবহার করেন। ‘বিষ’ কথাটি শুনলেই বুকের মধ্যে কেমন ধক করে ওঠে। বাজার থেকে সবজি কিনে খাচ্ছি, তা ‘বিষাক্ত’ হবে কেন? কিন্তু সত্যিই আজকাল এ বিষয়টি আমাদের সবাইকে ভীষণ ভাবায়। এই বিষাক্ততার অন্যতম কারণ হলো অধিক লাভের আশায় ফসলের খেতে নির্বিচারে রাসায়নিক কীটনাশক-বালাইনাশক ব্যবহার করা, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা আর সবজিকে টাটকা রাখতে বা দ্রুত ফল পাকানোর জন্য বিষাক্ত ফরমালিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার করা। ‘বালাইনাশক তথা কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া যায় না’—এই বিশ্বাসে চাষিরাও এসবের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল এবং প্রায় সব মৌসুমে ব্যবহার করেন। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, মাটির গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে, উদ্ভিদ ফসলে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যহীনতা।
তবে আশার কথা হলো দিন দিন ঝুঁকিমুক্ত, বিষমুক্ত আর নিরাপদ খাদ্যের দাবি ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। আমাদের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির স্বার্থেই আমাদের এমন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে, যা একই সঙ্গে কৃষক ও পরিবেশবান্ধব। এ ক্ষেত্রে ‘জৈব কৃষি’ অর্থাৎ ‘অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচারের’ কোনো বিকল্প নেই।
জৈব কৃষি এমন একটি আদর্শ পদ্ধতি, যা প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বিত ও টেকসই। জৈব কৃষি নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী–পুরুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও সৃষ্টি করে। জৈব কৃষি পদ্ধতিতে মাটি সব সময় উর্বর থাকে এবং এই উর্বরতা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের জৈবসারের উৎস হচ্ছে খামারজাত সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, কেঁচো সার, উদ্ভিদ ও জৈব উৎস থেকে পাওয়া অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সবুজ সার, অ্যাজোলা, ছাই। জৈব কৃষিতে কিছু কিছু পাতা, কাণ্ড, ডাল, মূল বা বাকলের রস কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক প্রকার গাছগাছড়া আছে যেগুলো পশুপাখির নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ষাটের দশকে ‘সবুজ বিপ্লব’ স্লোগান নিয়ে এ দেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকনির্ভর এক কৃষিব্যবস্থার সূচনা হয়। কিন্তু কৃষিকাজে অবিবেচকের মতো অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করে আমরা মাটির উপকারী অণুজীবগুলো মেরে ফেলেছি। বিনষ্ট করেছি কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি। আর এসব বিষ জলাশয়গুলোয় জমে ধ্বংস করে ফেলেছে সুস্বাদু দেশি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে এখন জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ ‘আইপিএম’ পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের খেতের পোকা দমন করা হয়, যাতে করে রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর কৃষকের নির্ভরতা কমে আসে। ‘আইপিএম পদ্ধতির’ বা ‘সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার’ মাধ্যমে বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় যেসব উপাদান–পণ্য রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উপকারী বন্ধু পোকার লালন ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা। ২০০৫ সালের গোড়ার দিকে ‘উজবেকিস্তান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের’ কৃষিবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের কয়েকজন কৃষিবিদের কাছে ‘উপকারী বন্ধু পোকার’ বাণিজ্যিক উৎপাদন কৌশল হস্তান্তর করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কিছু পোকার সেক্স ফেরোমন উৎপাদন কৌশল হাতে–কলমে শিখিয়ে দেন। তখন থেকেই যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উপকারী বন্ধু পোকা ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ উৎপাদন। সফল গবেষণার পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘আইপিএম’ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ফসল উৎপাদন এলাকায় উপকারী বন্ধু পোকা ওপোকার সেক্স ফেরোমন কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কৃষকেরা সানন্দে এগুলো গ্রহণ করেছেন এবং এর সুফল পেতে শুরু করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘আইপিএম কার্যক্রম’ জৈব কৃষির বিস্তারে বিপ্লব ঘটিয়েছে। জৈব কৃষিতে উৎপন্ন শাকসবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রপ্তানির কার্যক্রম আমাদের কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে, বয়ে আনতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশে চলছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সহযোগিতামূলক গবেষণা সহায়তাকারী কার্যক্রম। বাংলাদেশের বিএআরসি, বারি, ব্রি, বিজেআরআই, বিএসআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও জৈব কৃষি দ্রুত প্রসার লাভ করছে। বেসরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে জৈব কৃষি নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুড সেফটি নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন)। নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এমন পাঁচটি সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক এটি। সংগঠনগুলো হলো কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), উবিনীগ, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, শিসউক ও বিসেফ ফাউন্ডেশন। এই নেটওয়ার্ক জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় ২০১০ সালে গঠিত হয়। বর্তমানে এফএওর কারিগরি সহযোগিতায় ও বাংলাদেশ সরকার ও নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় দেশব্যাপী নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো জৈব কৃষি আন্দোলন।
‘জৈব কৃষি’ কৃষকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে ‘হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ গ্রাম পর্যায়ে কম্পোস্ট সার ও জৈব বালাইনাশক উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নকে তারা ‘আদর্শ অর্গানিক ইউনিয়ন’ হিসেবে গড়ে তুলছে। একইভাবে ‘বিসেফ ফাউন্ডেশন’ বিভিন্ন ইউনিয়নকে ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মডেল এলাকা’ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সরকারি উদ্যোগও এখানে প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ সরকারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে বিসেফ ফাউন্ডেশন তিনটি গ্রামের মানুষকে একত্র করে গড়ে তুলছে ‘বায়োভিলেজ’। বায়ো ভিলেজের প্রতিটি বাড়িতে উৎপাদন ও ব্যবহার করা হচ্ছে কেঁচো সার, কম্পোস্ট সার, বিভিন্ন ফাঁদ ও জৈব বালাইনাশক, ধানের জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে এনেছে, মাছের বৃদ্ধি বা খাবারের জন্য কোনো প্রকার কেমিক্যাল বা হরমোন ব্যবহার হচ্ছে না। সরিষাখেতে মৌমাছি ব্যবহার করায় পরাগায়নের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সঙ্গে মধুও পাওয়া যাচ্ছে। এই ‘বায়োভিলেজ’ সারা দেশের জন্য ‘জৈব কৃষি গ্রামের’ মডেল হতে পারে।
জৈব কৃষির আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হচ্ছে ‘সেনসি প্রকল্প’, যেখানে কৃষকদের জন্য অর্গানিক সবজি চাষের ট্রেনিং দেওয়া এবং অর্গানিক সবজি উৎপাদন করে তা বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঁচ জেলার পাঁচটি গ্রামে জাইকার অর্থায়নে জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ কমিউনিকেশন এবং উইন ইনকরপোরেট মিলে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।
বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদন সংস্থা যেমন ‘এসিআই কোম্পানি’ জৈব সার উৎপাদন ও চাষিদের সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুস সালাম ‘অ্যাকোয়াপনিক’ পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই সম্পূর্ণ ‘রাসায়নিকমুক্ত’ পদ্ধতিতে সবজি ও মাছ চাষের অভিনব পদ্ধতি উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁকে জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত করেছে। এই ‘অ্যাকোয়াপনিক’ পদ্ধতি জৈব কৃষির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যা বাড়ির ছাদে বা আঙিনায় স্বল্প পরিসরেও করা সম্ভব। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বসতভিটার আঙিনা ও চারপাশ এবং শহুরে এলাকার বাড়িঘরের ছাদকে নির্বাচন করা যেতে পারে।
ইউরোপীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফআইবিএলের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত এক দশকে অর্গানিক কৃষিপণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ শতাংশ। অর্গানিক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স। ১৬৪টি দেশে বর্তমানে সার্টিফায়েড অর্গানিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তাই একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অর্গানিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিওপিএমএ) মাধ্যমে এরই মধ্যে দেশের এক লাখ একর জমিকে অর্গানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে পুরো দেশকে অর্গানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে সংস্থাটি কাজ করছে। সরকার ২০১৬ সালে ‘জৈব কৃষিনীতি’ অনুমোদন করেছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ফসল উৎপাদনের কথা বিবেচনায় রেখে বর্তমান সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন–২০১৩ প্রণয়ন করেছে, যার ৫৮ ধারায় বলা আছে যে ‘মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য, কীটনাশক বা বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।’
‘বিষমুক্ত সবজি’ নিয়ে আমাদের নিত্যদিনের ভাবনাকে নির্বিষ করে দিতে পারে ‘জৈব কৃষি’। এতে কৃষক পণ্যের মূল্য বেশি পাবেন, পরিবেশ থাকবে দূষণমুক্ত আর আমাদের সোনা ফলানো মাটি হবে আরও উর্বর।

ড. কাশফিয়া আহমেদ: কৃষিবিদ, প্রধান নির্বাহী, উইন ইনকরপোরেট।