উৎসব সফল হওয়ার প্রধান কারণ মানুষ

আবুল খায়ের
আবুল খায়ের

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবটি শুরু করেছিলেন কেন?
সেটা ছিল একটা স্বপ্নযাত্রা। শৈশব থেকে আমি সংগীত অনুরাগী। ব্যবসার খাতিরে বিভিন্ন দেশ ঘুরতে গিয়ে দেখেছি নিজেদের সংগীত নিয়ে তারা উৎসবের আয়োজন করে। ভারতে প্রচুর উৎসব হয়। উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবও হয়। তবে সেই উৎসবগুলোতে খুব বেশি দর্শক হয় না। দেখলাম সেই উৎসবগুলোকে পরিচিত করাতে কাজ করছেন বাংলাদেশের মানুষেরাই। আলাউদ্দিন খাঁ, আলী আকবর খাঁ, নিখিল ব্যানার্জি, রবিশঙ্কর, উদয় শংকর, বিলায়েত খাঁ, ইমদাদ খাঁ সাহেবেরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতে চলে যান। আগে রাজা-বাদশাহ-জমিদারেরা সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। এখন সেটা হচ্ছে না। কিন্তু এই সংগীতের শিকড় আমাদের রক্তের ভেতরেই প্রবহমান। পাঁচ বছর আগেও কিন্তু মনে হতো শুদ্ধসংগীত বাংলাদেশে বোধ হয় বিলুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু দেখেছিলাম রাজশাহী, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছোট পরিসরে তখনো ঘরে ঘরে শুদ্ধ সংগীতের চর্চা হচ্ছিল। শৈশবে শোনা শুদ্ধসংগীত নিয়ে তাই একটি উৎসব শুরু করলাম।
কীভাবে শুরু করেছিলেন?
মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছিলাম। তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন। যেকোনো ভালো কাজে তিনি সব সময় উৎসাহ দেন। নিবন্ধনের মাধ্যমে দর্শককে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বছরে নিবন্ধন করে ২০ হাজার শ্রোতা। সে সময় ফরহাদুল ইসলাম আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি এই উৎসব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন। আমার পরামর্শমতো পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা এবং মানুষের স্বস্তি নিশ্চিত করতে যা যা করা প্রয়োজন ছিল, এর সবই তিনি করেন। জানেন হয়তো, এ উৎসবের জন্য আমরা চেয়ার পর্যন্ত বাইরে থেকে আমদানি করেছিলাম।
এর সাফল্যের প্রধান কারণগুলো কী ছিল?
এ উৎসব সফল হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ ছিল মানুষ। বাঙালি সংগীত ভালোবাসে, তার রক্তে শুদ্ধসংগীত বয়ে চলেছে। নানা কারণে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সে হয়তো একটু সরে গেছে এই সংগীত থেকে। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়ার পর কী হলো সে তো পুরো জাতি দেখেছে। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সময় মানুষ এখানে না এসে পারে না। ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিবছর মানুষ আসত। দ্বিতীয়ত, এর ব্যবস্থাপনা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। তৃতীয়ত, এর নিরাপত্তা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহযোগিতা ছিল উল্লেখ করার মতো। এইজেস নিরাপত্তা বাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষায় যথেষ্ট ভালো কাজ করত। দেশের গণমাধ্যমগুলো ছিল এ উৎসবের ব্যাপারে আন্তরিক। দেশ-বিদেশের শিল্পীরা এ উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে এসেছেন, সংগীত পরিবেশন করেছেন। সাফল্যের পেছনে তাঁদের অবদান অনেক। সর্বোপরি এ সাফল্য বাংলাদেশের।
এটি কোন দিক থেকে আমাদের দেশের জন্য গৌরবের?
বিদুষী গিরিজা দেবীর মতো কিংবদন্তিরা এ দেশে পরিবেশন করতে এসেছিলেন, এটা এ দেশের জন্য গৌরবের। শুধু তিনিই নন, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, শিবশঙ্কর শর্মা, ওস্তাদ আশীষ খাঁ, অজয় চক্রবতী, পণ্ডিত উলহাস কশলকর, ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত কুশল দাস, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার, ওস্তাদ জাকির হোসেনের মতো শিল্পীরা এ দেশে এসে বাজিয়ে গেলেন, এটা আমাদের জন্য গৌরবের নয়? সারা পৃথিবীতে এ উৎসব নিয়ে আলোচনা হয়। বড় বড় শিল্পী এখানে বাজাতে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বড় বড় তারকা এ উৎসব উপভোগ করবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। টুইটারে অনেকে নিজেদের সেই ইচ্ছের কথা লিখেছেনও। এ উৎসব আমাদের জন্য অনেক বড় একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছিল। সে জন্য আমরা ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’ করতে পেরেছিলাম। ১৬ জন গুরু এর সঙ্গে যুক্ত হলেন, উলহাসজির মতো নামী শিল্পী স্কুলটির অধ্যক্ষ হলেন। এগুলো গৌরবের ব্যাপার।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ২১ ডিসেম্বর ২০১৬