রোগ তাড়ানোর অগ্রগামী

জাতীয় ক্রিকেট দলের তাসকিনকে আমরা যদি দেশের যুব সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যের প্রতীক হিসেবে ধরে নিই, তাহলে এটাও স্বীকার করে নিতে হবে, প্রাণবন্ত এই বলিষ্ঠ গতিঝড়ের পেছনে একটি বড় অবদান আছে এই যুবকের শৈশবকালে দেওয়া একঝাঁক রোগের টিকার। দেশের মাঠে-ঘাটে, রাস্তায়-স্কুলে, অফিস-আদালতে আজ ২৫ বছর বা তার কম বয়সী যে কোটি কোটি শিশু-যুবার দেখা মেলে, তাদের অনেককেই আমরা দেখতে পেতাম না ওই টিকাগুলো না দেওয়া হলে। তাদের অনেককেই হয়তো আজ আমরা পঙ্গুদশায় পেতাম।

টিকাদানের এই দেশব্যাপী উদ্যোগের নাম সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের যে ঈর্ষণীয় আসন, তার ভিত্তিমূল বলে গণ্য হয় এই কর্মসূচিকে।

বিশ্বজুড়ে টিকার উদ্ভাবন, প্রয়োগ ও কার্যকারিতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। পরজীবী বা প্যারাসাইটিক রোগের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকারিতা না থাকলেও ব্যাকটেরিয়াজনিত, বিশেষ করে ভাইরাসজনিত রোগে টিকার কার্যকারিতা এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ, নির্মূল এমনকি উচ্ছেদে বিস্ময়কর ভূমিকা রাখছে। অতি পুরোনো দিনে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে শুরু করে সাম্প্রতিক কালে ইবোলা, ডেঙ্গু, জিকাসহ নবোদ্ভূত যেকোনো রোগে মানবজাতি শুধু নয়, প্রাণিকুলকেও রক্ষা করে চলেছে টিকার জাদু। আর শুধু সংক্রামক রোগই বা বলি কেন, অসংক্রামক ভয়াবহ রোগ ক্যানসারেও কার্যকর হচ্ছে টিকা। ডায়াবেটিস রোগে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতেও বিজ্ঞানীরা দ্বারস্থ হচ্ছেন টিকার। এসব আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থায় সমানতালে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। 

ইতিমধ্যে আটাশ বছরে পড়ছে দেশের ইপিআই। স্বাধীনতার আট বছরের মাথায় ১৯৭৯ সাল টিকাদানের যে গাছটি রোপিত হয়, সেটি আজ বিশাল এক মহিরুহে রূপ নিয়েছে। দেশের কোটি কোটি শিশু-যুবাকে ছাতার মতো সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে এই কর্মসূচি। আমাদের যুব নারীরা যে ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশে; সমানতালে শুধু যে পাশের বাড়ির ভারতীয়, নেপালিদের সঙ্গে লড়ছেন তা-ই নয়, বরং জাপানি, থাই, চীনা নারীদের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন; এর পেছনে অবদান আছে বাংলার স্বাস্থ্য খাতের লাখো মাঠকর্মী, কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য বিভাগ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর ইউনিসেফের। সেই সঙ্গে অবদান স্বীকার করতেই হবে দেশের রাজনীতিক, ইমাম, পুরোহিত আর অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের।
বহুল প্রচলিত বচন ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়’, সত্যিকার অর্থে তা সার্থকতা পেয়েছে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কোনো রোগকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধে। অনেক সতর্কতা সত্ত্বেও কোনো রোগ হতেও পারে, অনেক বেছে বেছে খেয়েও অনেকে অ্যাসিডিটি কমাতে পারেন না, ঝড়বৃষ্টিতে না ভিজেও অনেকে ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা পান না। কিন্তু টিটেনাসের কার্যকর টিকা দিলে, টিটেনাস হবে না ধরেই নেওয়া যায়। জলাতঙ্কের টিকা দিয়ে আজ অসংখ্য মানুষ নিশ্চিত জলাতঙ্কের ভয়াবহ মৃত্যু থেকে রক্ষা পাচ্ছে। প্রায় শোয়া দুই শ বছর আগে ১৭৯৮ সালে ড. এডওয়ার্ড জেনার গোবসন্ত থেকে যে টিকার দ্বীপশিখা প্রজ্বালন করেন, কালের পরিক্রমায় তা স্বাস্থ্যরক্ষায় আজ বিশাল এক বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত ২৫টি সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধসহ ক্যানসার চিকিৎসায়ও মমতাময়ী হাত বাড়িয়েছে জেনারের টিকার চতুর্থ প্রজন্ম। টিকার কার্যকারিতা শুধু একক ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধেই নয়, বরং হার্ড ইম্মিউনিটি (গোষ্ঠীর রোগবালাইমুক্তি) তৈরি করে সেই জনগোষ্ঠীতে সে রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করে রোগটিকে নির্মূলের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দুনিয়া থেকে গুটিবসন্তের নির্মূল হওয়া। এই বিশ্ব গুটিবসন্ত নামের ভয়াবহ সংক্রামক রোগের থাবা থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে ইপিআই যে এত সফল, তার কারণ খুঁজতে গেলে আশ্চর্যই হতে হয়। আমিও দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবে। বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে ১০ দিনের নিবিড় প্রশিক্ষণ শেষে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ি ইপিআই কার্যক্রমে। শুরু করি মাঠকর্মীদের নিবিড় প্রশিক্ষণ। সকাল থেকে বিকেল অবধি প্রশিক্ষণ, বক্তৃতা, প্রদর্শন, হাতে-কলমে শিক্ষণ চলে। প্রচার-প্রচারণা হলো ব্যাপক; রাজধানী, বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নে একের পর এক সভা-সমাবেশ। জজ, ব্যারিস্টার, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, গণ্যমান্য—সবাই যুক্ত হলেন টিকা মহাযজ্ঞে। সাজ সাজ রবে প্রশিক্ষণ, অ্যাডভোকেসি, দ্রব্যাদি সংগ্রহ এবং তারপর শুরু হয় ইপিআই কার্যক্রম। আমরা সিডিআই ৮০ সিসির হোন্ডা মোটরসাইকেলে চষে বেড়াই গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, গ্রাম, পাড়া, বাড়ি। কোথাও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের বাড়িতে বসেছে টিকাদান কেন্দ্র, কোথাও সদস্য বা স্থানীয় কোনো মাতবরের বাড়িতে। লোকে লোকারণ্য উঠান, বারান্দা, আঙিনা। বাড়ির লোকেরা চা-নাশতা শুধু নয়, পিঠা-পায়েস, সেমাই খাইয়ে আদর-যত্ন করেছেন আপনজনের মতো। কেউ কেউ খাসি পর্যন্ত জবাই করে খাইয়েছেন। সবচেয়ে যে বিষয়টি আমাকে নাড়া দেয়, তা হলো, ইপিআই বিষয়ে জনসচেতনতা, অ্যাডভোকেসি কমিউনিকেশন ও সোশ্যাল মবিলাইজেশনের (এসিএসএম) সাফল্য। আমাদের গ্রামের মায়েরা নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও যে সর্বজনীন সচেতনতা দেখিয়েছেন, তাই সম্ভবত বাংলাদেশের ইপিআইয়ের সাফল্যের অন্যতম কারণ। অনেক সময় দেখেছি, কেন্দ্রে টিকা বা স্বাস্থ্যকর্মী সময়মতো পৌঁছানোর আগেই কাঁচা নাড়ি নিয়ে দেড় মাসের বাচ্চা কোলে রোদে দাঁড়িয়ে শ্যামলবরণ জননী।
এ দেশে ইপিআই কয়েকটি বাঁক অতিক্রম করেছে। ১৯৭৯ সাল থেকে এক দশক ইপিআইয়ের শৈশব পর্ব, হাঁটি হাঁটি পায়ে চলা। এই সময় বিসিজি, পোলিও, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কার ও হামের টিকার সীমিত পরিসরে প্রচলন শুরু হয়। ১৯৯০ থেকে দ্বিতীয় দশক ইপিআইয়ের কৈশোরকাল। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সাজ সাজ রবে পুনরুজ্জীবিত কর্মসূচিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া হয় এই সময়ে। এটির কাভারেজ এ সময় ২ থেকে ৬৫ শতাংশে পৌঁছায়। তৃতীয় দশক ইপিআইয়ের যৌবনকাল। ২০০০ সাল থেকে বেশ কয়েকটি নতুন টিকার সংযোজন; ২০০৩ সালে ইপিআইয়ে যুক্ত হয় ভয়াবহ জন্ডিস রোগ হেপাটাইটিস-বি রোগের টিকা। বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের মধ্যে এ রোগের হার ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আমি নিজে গবেষণা করে ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ হারে হেপাটাইটিস-বি পেয়েছি ঢাকার মহাখালী ও কালিয়াকৈরের বয়স্ক মানুষের মধ্যে। ১৪ বছর বয়স বা তার নিচের সব কিশোর-কিশোরী শিশু আজ হেপাটাইটিস-বি অভিশাপ থেকে মুক্ত; তারা ভুগবে না লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারে। এরপর ২০০৯ সালে যুক্ত হলো হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি রোগের টিকা; শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের মারাত্মক সংক্রমণে শিশুনাশের এই রোগটি আর হবে না সামনের প্রজন্মের। টিকার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অনেক টিকাকে সহনীয় করার বুদ্ধিও এসেছে; পাঁচটি টিকাকে একসঙ্গে করে পেন্টা টিকার প্রচলন হয়েছে ইপিআই কর্মসূচিতে। ২০১০ সাল থেকে চলছে ইপিআইয়ের চতুর্থ দশক, নতুন নতুন আরও রোগের টিকা যুক্ত হয়েছে এই কর্মসূচিতে। ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশে উত্তরণ ঘটেছে কাভারেজের। ভয়াবহ আরেক রোগ মেনিনজাইটিস বা এনকেফালাইটিস প্রতিরোধে ২০১৪ সালে যুক্ত হয়েছে টিকা পিসিভি। বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত হয়েছে সগৌরবে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে। টিটেনাসসহ আরও কিছু রোগ পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার পথে। এককালে ১০ থেকে ২০টি সন্তানের জন্ম দিয়েও এক বা দুটি সন্তানের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার নিশ্চয়তা পেতেন না মায়েরা। এসব মৃত্যুর মিছিলের সিংহভাগ ছিল ইপিআই আওতাভুক্ত সংক্রামক রোগ। শুধু হামের কারণেই কত হাজার লাখ শিশু যে অকালে অনাবশ্যক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, তার আঁচ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক কালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বার্মাপাড়ার শিশুদের হামজনিত মৃত্যু থেকে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর ইপিআই সূচকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উচ্চ হারের গুটি কয়েক দেশের একটি। এই অঞ্চলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১১টি সদস্যদেশের অনেক দেশই আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও ইপিআইয়ে সাফল্য বাংলাদেশকে জনস্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদার আসন দিয়েছে। মধ্যম আয়ের অবস্থান পেরিয়ে উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশের যে স্বপ্ন আমরা এখন দেখার সাহস রাখি, তা যে শুধু অর্থনৈতিক সূচক দিয়ে নির্ধারিত হবে, তা নয়, জনস্বাস্থ্যের সূচকগুলোকেও টেকসই রাখতে হবে।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ

জাতীয় পরামর্শক, ইউনিসেফ
সমন্বয় ও সহায়তা কেন্দ্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী