আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু

একটা দেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতি পরিমাপের যদি কোনো সার্বিক সূচক খুঁজতে হয়, তাহলে সেটা হতে পারে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি। জাতি, সমাজ, পরিবার—যেকোনো পর্যায়ে উন্নয়ন বা উৎকর্ষ লাভের যেসব প্রচেষ্টা নেওয়া হয়ে থাকে যেমন: আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশগত বা অভ্যাসগত—এ সবকিছুরই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে ব্যক্তি বা মানবকল্যাণ। আর এগুলোর সামগ্রিক সুফল গড় আয়ু বৃদ্ধি।
পরিসংখ্যান মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৪ থেকে ৪৫ বছর। ২০১৬ সালে এটি বেড়ে প্রায় ৭২ (৭১ দশমিক ৬) বছরে দাঁড়িয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাংলাদেশের বর্তমান গড় আয়ু বৈশ্বিক গড় আয়ুর (৭১ দশমিক ৪ বছর) চেয়ে বেশি। গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে প্রায় ২৬ থেকে ২৭ বছর। এই একই সময়ে বৈশ্বিক গড় আয়ু বেড়েছে মাত্র ১২ বছর (৫৯ থেকে ৭১ বছর) এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গড় আয়ু বেড়েছে ১৩ বছর (৫৩ থেকে ৬৬ বছর)।
২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শুধু মালদ্বীপ (৭৮ দশমিক ৫ বছর) ও শ্রীলঙ্কা (৭৪ দশমিক ৯ বছর) গড় আয়ুর হিসাবে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। ভারতসহ অন্যান্য দেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতে গড় আয়ু ছিল ৬৮ দশমিক ৩ বছর, ভুটানে ৬৯ দশমিক ৮ বছর, নেপালে ৬৯ দশমিক ২ বছর, পাকিস্তানে ৬৬ দশমিক ৪ বছর এবং আফগানিস্তানে সর্বনিম্ন ৬০ বছর (সূত্র: বিশ্বব্যাংক)।
গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক উন্নয়ন, যেমন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য পরিস্থিতির ঈর্ষণীয় উন্নতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার দৃশ্যমান অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন, দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি—এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতির বড় ভূমিকা রয়েছে। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ায় ক্রমান্বয়ে মা ও শিশুর অপুষ্টির হার কমে এসেছে। স্বাস্থ্যসেবাদান অবকাঠামো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার ফলে গ্রামের বিপুল জনগোষ্ঠী, শিশু থেকে বৃদ্ধ, পুরুষ থেকে নারী—সবাই রোগব্যাধির হাত থেকে মুক্ত হতে সহজে সেবা নিতে পারছেন, টিকা গ্রহণ করে সন্তানদের নানা রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে পারছেন। গ্রাম-শহর সর্বত্র এবং সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ায় সমাজে স্বাস্থ্য-সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে এবং আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণেও জনগণ কুসংস্কারমুক্ত হয়েছে।
মোটাদাগে দারিদ্র্য ও খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি, স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন—এসবেরই একটি সামগ্রিক সুফল হিসেবে তিন থেকে চার দশক ধরে দেশে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় সব ধরনের মৃত্যুর হার কমে এসেছে। এগুলোর সামষ্টিক সুফল হচ্ছে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে জনগণের সার্বিক মৃত্যুহার কমেছে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (প্রতি হাজারে ১৯-২০ থেকে বর্তমানে ৫)। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমেছে ৮০ শতাংশেরও বেশি (প্রতি হাজারে ২৫১ থেকে বর্তমানে ৩৫) এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশের মতো (প্রতি লাখ শিশুর জন্মে ৫৭৪ থেকে ১৭০)।
সাম্প্রতিক দশকগুলোয় দেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির অভূতপূর্ব সাফল্যে আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। কারণ, এখনো পথ দীর্ঘ। জনগণের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশে প্রতিটি মৃত্যুহারই আরও অনেক কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো ১৩ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে এবং এক-চতুর্থাংশেরও বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, যারা সুস্থ জীবনযাপনের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি করা হলেও এখনো বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশের মতো শিশু ও ১৯ শতাংশ মা অপুষ্টিতে ভুগছেন।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে বটে, কিন্তু সেবা কি পৌঁছেছে? বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে স্বাস্থ্য-জনবলের প্রকট অভাব এবং জনবলকাঠামোতেও যথেষ্ট অসংগতি রয়েছে, ফলে যথাযথ সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে জনসংখ্যা রয়েছে ৩ হাজার ২৯৭ জন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে জনসংখ্যা হওয়া উচিত ১ হাজার ৪০০ জন। একইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে রয়েছেন মাত্র শূন্য দশমিক ৪ জন নার্স। এই জনবলঘাটতি পল্লি এলাকায় সীমাহীন। দেশের মোট স্বাস্থ্য-জনবলের ২০ শতাংশেরও কম জনবল নিয়োজিত রয়েছেন পল্লি এলাকায়, যেখানে দেশের ৭৫ শতাংশেরও বেশি লোক বসবাস করে। পল্লি এলাকায় ১৫ হাজার লোকের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন, যেখানে শহরে রয়েছেন ১ হাজার ৫০০ লোকের জন্য একজন চিকিৎসক। পল্লি এলাকার স্বাস্থ্যসেবার আরও যে দুরবস্থার কথা জানা যায়, তা হলো অধিকাংশ সেবাদান প্রতিষ্ঠানে হয় কোনো চিকিৎসক নেই, নইলে চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকছেন। কোনো কোনো তথ্যে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে কোনো আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং প্রায় ৭০ শতাংশ ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে কোনো মেডিকেল অফিসার নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোয় বিশেষভাবে পল্লি এলাকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব এখন সর্বজনবিদিত। জেলা হাসপাতালগুলোয় কোনো করোনারি কেয়ার ইউনিট, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট নেই, যার সেবা মেট্রোপলিটন শহরের বাইরে বসবাসকারী রোগী ব্যবহার করতে পারে।
সরকারি নীতিমালায় থাকলেও মাতৃমৃত্যু কমাতে এ পর্যন্ত মাত্র এক-চতুর্থাংশ উপজেলা হাসপাতালে জরুরি মাতৃস্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মৌলিক প্রসূতি ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এ পর্যন্ত কেবল এক-তৃতীয়াংশের মতো মাকে কার্যকরভাবে এ সেবার আওতায় আনা হয়েছে। দেশে এখনো প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মা বাড়িতে সন্তান প্রসব করেন। প্রায় ৬০ শতাংশ মা সন্তান জন্মদানের সময় কোনো প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা সাহায্যকারীর সহায়তা পান না এবং দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মা গর্ভকালীন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন চারবার গর্ভকালীন সেবা নিতে পারেন না (সূত্র: বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪)। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়ে এখনো বাল্যবিবাহের কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিতে রয়েছে, যদিও পরিবার পরিকল্পনার সাফল্যের কারণে বেশি বয়সে এবং বেশিসংখ্যায় সন্তান জন্মদানের ঝুঁকি থেকে মায়েদের রক্ষা করা গেছে, যা অতীতে মাতৃমৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।
এসব সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করা গেলে ভবিষ্যতে দেশে গড় আয়ু আরও বাড়বে। বিভিন্ন প্রক্ষেপণে দেখা যায়, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এগিয়ে যেতে পারলে দেশে গড় আয়ু ২০২৫-৩০ সালে ৭৫ থেকে ৭৬ বছর হতে পারে এবং ২০৪৫-৫০ সালে প্রায় ৮০ বছর ছুঁয়ে যাবে।

শত সমস্যা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও গড় আয়ু বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে অর্জন দেখিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। তবে ক্রমাগত গড় আয়ু বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি জনমিতিক চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে, যা নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে। এই ক্রমাগত গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যতে জনগণের বয়স-কাঠামোতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে, যে প্রক্রিয়াটি এই মুহূর্তে কিছুটা চলমানও রয়েছে। ক্রমাগত গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যতে দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলক হারে বাড়বে এবং প্রবীণ লোকেরা অনেক দিন বেঁচেও থাকবেন। বিভিন্ন প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের জনসংখ্যা বেড়ে ২ কোটিরও বেশি হতে পারে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা হবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটির মতো; আরেকটু এগোলে, শতাব্দী শেষে এটি হবে প্রায় সাড়ে ৬ কোটির মতো। শতকরা হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ প্রবীণ জনগোষ্ঠী দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১২ ভাগের মতো হবে এবং ২০৫০ সালে তা হবে প্রায় ২২ থেকে ২৩ ভাগ, যে সংখ্যাটি তখনকার ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের সংখ্যার চেয়ে বেশি থাকবে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর এই ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকায় দেশের আর্থসামাজিক, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা ধরনের এবং কখনো কখনো নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারেরও আশঙ্কা রয়েছে। দেশ যদি এখন থেকে এ বিষয়ে সতর্ক না হয় এবং ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও সম্ভাবনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে হয়তো একসময় কিছুটা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হতে পারে। আত্মতুষ্টি থেকে বেরিয়ে তাই বাস্তবমুখী হওয়া প্রয়োজন।

শরীফা বেগম, সাবেক গবেষক, বিআইডিএস