সব বাধা পেরিয়ে

রুমানা আক্তার,সজীব রায়,লতা আক্তার,রেখা খাতুন
রুমানা আক্তার,সজীব রায়,লতা আক্তার,রেখা খাতুন

সকালে পান্তাভাত খেয়ে বিদ্যালয়ে যেত রুমানা আক্তার। বেশির ভাগ দিন ফিরে খাবার জোটেনি। এভাবে লেখাপড়া করে এবার দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এক রিকশাচালকের এই মেয়ে।
এমন গল্প একা রুমানার নয়। এভাবে কষ্টের বাধা পেরিয়ে সফলতা পেয়েছে দিনাজপুরের গরিব দরজির ছেলে সজীব রায়, নীলফামারীর রাজমিস্ত্রির মেয়ে লতা আক্তার এবং রংপুরের বদরগঞ্জের অসুস্থ মা-বাবার সন্তান রেখা খাতুন।
চুলার আলোয় উজ্জ্বল রুমানা: রুমানার বাবা রফিকুল ইসলামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের কিশামত হলদিয়া গ্রামে। অভাব-অনটনের সংসার। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় রুমানার বিয়ে ঠিক করেছিলেন তিনি। সেই বিয়ে ঠেকায় রুমানা। কখনো দিনের আলোয়, কখনো মাটির চুলার আলোয় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাকে।
রুমানা আক্তার বলে, ‘শিক্ষক হতে চাই। কিন্তু বাবা রিকশাচালক। তাঁর আয় দিয়ে সংসারই চলে না। লেখাপড়ার খরচ দেবে কে?’ মা আসমা বেগম বললেন, ‘কলেজোত পড়াতে ম্যালা ট্যাকা নাগে, তাক পামো কোনটে।’
নিজের চেষ্টায় সফল সজীব: দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ পৌরসভার মুশিদহাট ডাঙ্গিপাড়া মহল্লায় বাড়ি সজীব রায়ের। সেখানে এক বিঘা জমি বর্গাচাষ করে বছরের ভাতের সংস্থান করেন মা কল্পনা রানি। বাবা নিখিল রায় গাজীপুরের জয়দেবপুরে দরজির কাজ করেন। ব্রত নিয়েছেন ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। তাঁদের ছেলে এ বছর দৌলতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
কল্পনা রানি বলেন, ‘মাইনসের জমিত কাম করি। এত কষ্ট করি, খালি ছোয়াল যাতে মানুষ হয়। ছোয়াল নিজে চেষ্টা করি ভালো রেজাল কইছে।’
সেনা কর্মকর্তা হতে চায় লতা: নীলফামারী সদর উপজেলার কিশামত দোগাছি গ্রামের আবদুল লতিফের মেয়ে লতা আক্তার। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় সে টুপামারী দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
আবদুল লতিফ বলেন, ‘নিজের জমি নেই। কাজ করে প্রতিদিন দুই-আড়াই শ টাকা পাই। তা দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের খাওয়া জোটে না। প্রতিদিন কাজও থাকে না। অসুখ-বিসুখে ধার করে চলতে হয়। দেনা করে মেয়ের ফরম পূরণের শেষ দিন টাকা জমা দিয়েছিলাম।’
লতা আক্তার বলে, ‘বাবার স্বপ্ন আমাকে সেনা কর্মকর্তা বানাবেন। আমার সাধ আছে, কিন্তু বাবার সামর্থ্য নেই। সে কারণে চিন্তায় আছি।’
দুবেলা ভাত পায়নি রেখা: রেখা খাতুনের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। বাবা আবদুল হামিদ ও মা হামিদা বেগম অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারেন না। তাঁদের মেয়ে পাঠানপাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ছোট ভাই হারুন (১৪) বাড়িতে পাটের আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে। এতে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে।
রেখা খাতুন বলে, ‘কত দিন দুই বেলা ভাত পাইনি। প্রতিবেশী এক ভ্যানচালক বিনা পয়সায় বাড়ি থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে গেছেন।’
মা হামিদা বেগম বলেন, ‘রেখা দিন-রাইত পড়ার ওপরে থাকে। টাকা নাই। এ্যালা বেটিটাক ভর্তি করার টাকা পাইম কোনটে?’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নীলফামারী ও বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি]