শান্তির প্রহরী

এ মুহূর্তে বিশ্বের ১২টি মিশনে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ হাজার শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। ছবি: সংগৃহীত
এ মুহূর্তে বিশ্বের ১২টি মিশনে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ হাজার শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৮ সালের ১৪ আগস্ট জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি যাত্রীবাহী বিমানে একে একে উঠছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন অফিসার। তাঁরা ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে মেজর র‌্যাঙ্কের। বিমানে ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় এই অফিসাররা বিদায় নিচ্ছিলেন তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে। অফিসারদের একজন ছিলেন মেজর ফাতাহ। তাঁর ছোট্ট মেয়ে বুশরা বারবার বলছিল, ‘বাবা, তুমি যেয়ো না।’

অফিসারদের এই বিদায়পর্বটি অত্যন্ত আবেগঘন ছিল। যে কাজে তাঁরা যাচ্ছেন, সেটার ধরন সম্পর্কে কারোরই কোনো পূর্বধারণা ছিল না। কেননা দেশের সীমানার বাইরে এ রকম দায়িত্ব এর আগে কখনো পালন করেননি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো সেনা।

কুয়েত এয়ারলাইনসের ওই বিমানটির গন্তব্য ছিল কুয়েত সিটি। তবে ১৫ সেনা অফিসার সেখানে নেমে চলে যাবেন বাগদাদ। তারপর কয়েক দিনের মধ্যে ইরাক-ইরান সীমান্ত এলাকায় টহল দেওয়ার কাজে যুক্ত হবেন তাঁরা। ইউনাইটেড নেশনস ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ (ইউনিমগ) নামে জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষা মিশনের হয়ে কাজ করতে চলেছেন এই অফিসাররা। তাঁদের বহনকারী বিমানটি যখন রানওয়ে ধরে ছুটে গিয়ে ঢাকার আকাশে ডানা মেলে, তখন ওই অফিসারদের কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না যে তাঁরা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিকের সূচনা করতে চলেছেন। শান্তিরক্ষা মিশন নামে এক নতুন অধ্যায়ের তাঁরাই পথিকৃৎ।

প্রথম শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়া সেনাবাহিনীর ১৫ সেনা কর্মকর্তা যোগ দিয়েছিলেন নিরস্ত্র পর্যবেক্ষক হিসেবে। সেনাবাহিনী এঁদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নবান ছিল। বলতে গেলে নির্বাচিত সবাই সে সময় সেনাবাহিনীর প্রথম সারির কর্মকর্তা ছিলেন। মিশন এলাকায় এই কর্মকর্তাদের চৌকস ভূমিকা দেশের জন্য সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনে।

পরবর্তী ৩০ বছরে একে একে বাংলাদেশের ১ লাখ ৩২ হাজার ৬১৮ সেনাসদস্য ৪০টি দেশে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে (আগস্ট ২০১৭ পর্যন্ত) ১২৪টি দেশের ৯৫ হাজার ৪৬৭ জন শান্তিরক্ষী ১২টি মিশনে নিয়োজিত আছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আছেন ৭ হাজার ৬৩৬ জন (পুলিশসহ) শান্তিরক্ষী। একক দেশের সংখ্যার দিক দিয়ে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ইথিওপিয়া বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৫৫০ জন বেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত করে তালিকার শীর্ষে আছে। এর আগে বিশেষত ২০০৭-০৮ সাল থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় পুরো সময়জুড়ে এই তালিকার শীর্ষে ছিল। সে সময় সামরিক বাহিনী থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১০ হাজার শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হয়েছিল। গত ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ সালে সামরিক বাহিনী থেকে যথাক্রমে ৬ হাজার ৮৯ ও ৫ হাজার ৯১২ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত ছিলেন।

১৯৪৮ সালের ২৯ মে জাতিসংঘের প্রথম শান্তিরক্ষা মিশন কার্যকর হয় মধ্যপ্রাচ্যে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ৬৯টি শান্তিরক্ষা মিশন কার্যকর হয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনে স্থলবাহিনী মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও প্রয়োজনে বিমান ও নৌবাহিনী এবং বেসামরিক পুলিশও এ ধরনের দায়িত্ব পালন করে থাকে। শান্তিরক্ষীরা কখনো নিরস্ত্র আবার কখনো সশস্ত্র অবস্থায় দায়িত্ব পালন করেন।

জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৪টি মিশনেই অংশ নিয়েছে বা নিয়োজিত আছে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ১৯৮৯ সাল থেকে পুলিশ বাহিনী এবং ১৯৯৩ সাল থেকে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে আসছে।

শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের জন্য সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অতিরিক্ত কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এ কারণে সামরিক বাহিনীর শান্তিরক্ষীদের নিয়োগের আগে এবং দায়িত্বরত অবস্থায় বেশ কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয়। বিশেষত, সামরিক কর্মকর্তাদের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ দেশে শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশনস ট্রেনিং (বিপসট) নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। এই প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ আজ বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করছে। বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সামরিক বাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের সামনে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নিরপেক্ষতা ও পেশাগত দক্ষতার কারণে বিবদমান দেশ, দল বা গোষ্ঠীগুলো শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়োগের ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলে না।

 অশান্ত ও বিরোধপূর্ণ এলাকায় শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আজকের এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরিতে শান্তিরক্ষীদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া, অচেনা পরিবেশ এবং নির্বান্ধব এলাকায় দুষ্কৃতকারী বা বৈরী পক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে হানাহানি বা মারামারি শুরু করলে শান্তিরক্ষীদের তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে হয়। এতে কখনো কখনো জীবনহানিও ঘটে। শান্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ১১৫ জন শান্তিরক্ষী জীবন দিয়েছেন।

শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, একই সঙ্গে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে সরকার বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে। বর্তমান সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এটি একটি অন্যতম প্রধান উৎস।

শান্তিরক্ষীদের মধ্যে যাঁরা নিরস্ত্র এবং ব্যক্তি হিসেবে মিশন এলাকায় নিয়োজিত হন, তাঁরা জাতিসংঘের কাছ থেকে সরাসরি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে সমষ্টিগতভাবে বা কন্টিনজেন্টের শান্তিরক্ষীদের জন্য প্রযোজ্য আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। বাংলাদেশ সরকার পরে নিজস্ব নিয়মে শান্তিরক্ষীদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে। জাতিসংঘ এ দেশ থেকে মিশন এলাকায় নিয়ে যাওয়া কন্টিনজেন্টের সব উপকরণ ও সরঞ্জাম বিশেষত অস্ত্র, যানবাহন, অস্থায়ী আবাস ইত্যাদি ব্যবহারের ভাড়া বা ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাসিক হারে সরকারকে অর্থ প্রদান করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশেদ-উজ-জামান ও নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন, ‘সরকারি সূত্র থেকে জানা যায় যে ২০০১-১০ সময়কালে বাংলাদেশ সরকার সৈনিক নিয়োগ, কন্টিনজেন্টের নিজস্ব দ্রব্যসামগ্রী এবং অন্যান্য ধরনের ক্ষতিপূরণের জন্য জাতিসংঘ থেকে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।’ [কন্ট্রিবিউটর প্রোফাইল: বাংলাদেশ। রাশেদ-উজ-জামান ও নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬]। ২০১১-১২ সালে জাতিসংঘ শুধু দ্রব্যসামগ্রীর জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮২ হাজার ৪০২ মার্কিন ডলার প্রদান করেছে। [বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, পঞ্চম খণ্ড। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। মে ২০১৫। পৃ. ৪১৩]।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় শুধু যে জাতিসংঘ অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন তা নয়। তাঁরা সেখানে বাংলাদেশের দূত হিসেবেও কাজ করছেন। তাঁরা মিশন এলাকায় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁরা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। অনেক মিশন এলাকায় বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতি এতটাই অবধারিত বা গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে যে কখনো কখনো তা সরকারিভাবে স্বীকৃতিও পায়। সিয়েরা লিয়নে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে বাংলা ভাষাকে তাদের অন্যতম প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোনো কোনো দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সম্মানে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ রোড’। বেশ কিছু মিশন এলাকায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, কালচারাল সেন্টার ও চিত্তবিনোদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। মিশন থেকে শান্তিরক্ষীরা চলে আসার পর সাধারণত স্থানীয় লোকজন এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিভিন্ন সেবামূলক কাজেরও উদ্যোগ নেন। কোথাও কোথাও তাঁরা স্কুল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন। সব মিলিয়ে শান্তিরক্ষীরা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুনভাবে তুলে ধরছেন।

বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাদারির কারণে ১৯৮৮ পরবর্তী সময়ে প্রায় সব কটি শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও কর্মকাণ্ড, মানবিক গুণাবলি, শৃঙ্খলা এবং স্থানীয় জনগণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।’ [বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, পঞ্চম খণ্ড। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। মে ২০১৫। পৃ. ৪১১-১২]। শান্তিরক্ষা মিশনে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করব, সামরিক বাহিনী দেশের স্বার্থে আরও বেশি করে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে।

মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক