এগিয়ে চলার যাত্রায়

ট্রাফিক বিভাগে মোটরসাইকেল আরোহী নারী পুলিশ সদস্যরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ট্রাফিক বিভাগে মোটরসাইকেল আরোহী নারী পুলিশ সদস্যরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গত সপ্তাহে সকালের কাগজে কয়েকটি খবর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কুষ্টিয়ার আরদিনা ফেরদৌস পিস্তলে দুটি সোনা জিতেছেন। অন্যদিকে দেখলাম কেন্দুয়ার এক স্কুলছাত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করেছে এক বখাটে। সেই সঙ্গে জানতে পারলাম নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার দিক দিয়ে চতুর্থ খারাপ শহর ঢাকা।

ভাবলাম এর মধ্যেও প্রতিদিন সকালে হাজারো নারী এই ঢাকা শহরেই পোশাকশিল্পে ও অন্যান্য কাজে বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন। সহিংসতার ভয় থাকলেও এসব নারী তা উপেক্ষা করে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন। নারীরা কি দমে গেছেন এসব ভয়ে?

এই বাংলাদেশেই আমরা দেখতে পাচ্ছি আর্থসামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন ছাড়াও নারীর ক্ষমতায়নের বিভিন্ন সূচকেও উন্নতি ঘটছে। আমরাও বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্য দেশের মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হলো সমাজ ও মানব উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ ও উন্নয়ন অপরিহার্য।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নারী উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার প্রতিফলন আমরা সংবিধানে দেখতে পেয়েছি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আজ নারীরা সমাজ ও জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে বিচরণ করছেন। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে শ্রমিক, কর্মচারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হিসেবেও আজ নারীদের দেখা যাচ্ছে, যা দেখে নারী হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করি। নারীরাও হয়ে উঠেছেন আলোর সহযাত্রী।

নারী নির্যাতন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমিত অংশগ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব—এসব সমস্যা আমাদের সামনে রয়েছে। এসব সমস্যা সত্ত্বেও তো নারীর অগ্রগতি থেমে নেই। তাঁদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জায়গা করে নেওয়ার পেছনের সরকারি নীতিমালা ও ইতিবাচক উদ্যোগ এবং সেই সঙ্গে বেসরকারি সহযোগিতার ভূমিকা রয়েছে।

ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের ঘটনাটি ঘটে চলেছে অনেকটা অগোচরে। আর এটা ঘটছে নারীদের দারিদ্র্য দূরীকরণ থেকে শুরু করে তাদের অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত করার কিছু বিশেষ পদক্ষেপের কারণে। সরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ এই অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখছে।

নারী উন্নয়ন ও জেন্ডার ক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বেশ কিছু কর্মসূচি চালু আছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি। আমরা দেখেছি, ভিজিডি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ইত্যাদির আওতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী কেবল খাদ্য বা আর্থিক সহযোগিতাই পাচ্ছেন না, বরং কোনো কোনো কর্মসূচি দক্ষতা, জ্ঞান ও আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষমতায়নের মাধ্যমে হতদরিদ্র দশা থেকে তাঁদের বের করে আনছে। তাঁরা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন পরিবার ও সমাজের শক্তি।

দরিদ্র বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং যাঁদের পরিবারে উপার্জনশীল পুরুষ সদস্য নেই, তাঁদের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে যুক্ত করে স্বাবলম্বী করে তোলার কর্মকাণ্ড চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। পরবর্তী সময় থেকে গ্রামের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যাকাজে পরীক্ষামূলকভাবে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র নারীদের জীবিকার জন্য এসব কর্মসূচি আজ হয়ে উঠেছে অপরিহার্য।

কেয়ার বাংলাদেশ ও এলজিইডি গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় ৪ হাজার ৯৭টি ইউনিয়নে ৬১ হাজার ৪০০ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তা-ই নয়, ওই আয় থেকে তাঁদের সঞ্চয় করতে বাধ্য করা হয়েছে। তারপর আয়বর্ধনকারী প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়েছে। এই পরীক্ষামূলক কর্মসূচি খুবই সফল হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে অবকাঠামো সংরক্ষণে নারীদের নিযুক্তি নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হয়ে গেছে। বর্তমানে পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় দুস্থ নারীদের পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান ও মানব উন্নয়নের সুযোগ পাচ্ছেন ৫১ হাজার ৭৪০ জন নারী। সংখ্যাটি এখন আর নেহাত ক্ষুদ্র নয়। এ ধরনের প্রকল্প কেবল আয় করতে নয়, নারীর আত্মবিশ্বাসী হতেও সহায়ক হয়েছে।

কিছুদিন আগে কুড়িগ্রাম আর সাতক্ষীরার দুর্যোগকবলিত এলাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি দুস্থ নারীদের আত্মবিশ্বাস ও হাসিমুখ। ‘স্বপ্ন’ নামের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি প্রকল্প প্রায় সাড়ে চার হাজার নারীকে অন্য রকম স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের যে কেবল কর্মসংস্থান হয়েছে তা-ই নয়, প্রথম থেকেই তাঁরা পেয়েছেন জীবন ও জীবিকাবিষয়ক নানামুখী প্রশিক্ষণ আর হাতেকলমে ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ। আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁরা আর পরমুখাপেক্ষী হবেন না বলে জানান। তাঁদের চোখেমুখে যে আলো আমি দেখেছি, তার কোনো তুলনা হয় না। দোকানে ধার চাইতে গেলে একসময় যাঁদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, আজ তাঁরা নিজেরাই দোকান করছেন বাজারে। আর ক্রেতা হিসেবেও সমাদর পাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পোশাক কারখানায় কাজ বা অন্য প্রশিক্ষণ পেয়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁদের সন্তানেরা পেয়েছে নিরাপত্তা, খাবার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ।

কেবল গ্রামের নারীরাই কি এই অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছেন? শহরের নারীদের এগিয়ে চলাও থেমে নেই। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর অনেকেই বাধ্য হয়ে শহরে আসেন জীবিকা ও জীবনের তাগিদে। এসব পরিবারের নারীদের প্রাথমিকভাবে ঠাঁই হয় বস্তিতে। সেখানে অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ পরিবেশে বাস করে তাঁদের জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। নগরের নারীদের সমস্যা গ্রামের নারীদের মতো নয় বলে তাঁদের পোহাতে হয় অন্য রকম সমস্যা। বস্তিজীবনের এসব সমস্যাকে সামনে রেখেই সরকারি বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দুস্থ নারীদের সহায়তা দেয়।

কেবল পোশাকশিল্পই নয়, নগরের নারীদের অন্য রকম জীবনযাত্রাও রয়েছে। বস্তি এলাকার নারীদের সংগঠিত করে পরিচালিত হচ্ছে সঞ্চয়, ক্ষুদ্রঋণ ও আয়বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া বস্তি এলাকায় অবকাঠামো যেমন: ফুটপাত, ড্রেন, সড়কবাতি, নলকূপ—এগুলোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এগুলোয় নারীরা রয়েছেন ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্তগ্রহণে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব তৈরির পাশাপাশি নারীরা হয়ে উঠছেন সচেতন। নারায়ণগঞ্জের বস্তির নারী সদস্যরা বলেন, তাঁদের সড়কবাতি নষ্ট হলে বা অন্য সমস্যায় প্রথমে কাছের কমিশনারকে জানান। দুই-চার দিনে ঠিক না হলে তাঁরা সরাসরি মেয়রকেই ফোন করেন।

পৌর এলাকায় নারীদের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে এলজিইডির নগর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এগিয়ে গেছে আরেক ধাপ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন। পৌরসভাগুলোর জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে তার আওতায় আজ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে কেবল দরিদ্র নারী নয়, সব পর্যায়ের নারীরাই অংশ নিতে পারছেন। এ ছাড়া অবকাঠামোতে নারীদের জন্য সুবিধাগুলো তাঁরা নিশ্চিত করতে পারছেন। যেমন: বাস টার্মিনালে নারীদের বসার জায়গা বা টয়লেট, পৌর বাজারে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ইত্যাদি। পৌরসভায় সংরক্ষিত আসনের নারীদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করছে নগর ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি। বিভিন্ন কমিটির সদস্য ও সভাপতি হিসেবে তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। নারীর ভূমিকা রয়েছে বাল্যবিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, পৌরকর আদায় ও পৌরসভার পরিবেশ উন্নয়নে।

নারীদের বহুমুখী কর্মকাণ্ড তাঁদের করে তুলছে আত্মসচেতন। পৌরবাসীও বুঝতে পেরেছেন নারীরাও রাখতে পারেন বিশেষ ভূমিকা।

সকালবেলা গ্রামের স্কুলগুলোয় সারি বেঁধে যেসব কচি মুখ যেতে থাকে, তাদের দেখে বুকটা ভরে যায়। আমার ছোটবেলায় তো গ্রামের এত মেয়েকে স্কুলে যেতে দেখিনি। জানি বখাটেদের উৎপাত ও অত্যাচারের ভয় কাটিয়ে এই মেয়েরাই আস্তে আস্তে পেরিয়ে যাচ্ছে জীবনের এক-একটা ধাপ। স্কুলের সরকারি বৃত্তি আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া দেখে তাদের চোখেও খেলা করে স্বপ্ন। আজ বেশির ভাগ মেয়েকেই জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, কেউ হতে চায় শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ এনজিওকর্মী, কেউবা করতে চায় নিজের ব্যবসা। কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের কর্মী।

সরকারের নীতিমালার আওতায় আজ ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সুদে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছে। তা ছাড়া তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ। সেসব সুযোগ নিয়ে ঢাকা, সিলেট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো শহরের নারীরা করছেন ব্যবসা। যখন দেখি কোনো একজন নারী রপ্তানিকারক, হোটেল মালিক, প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পরিচালক, তথ্যপ্রযুক্তির জোগানদাতা; তখন ভাবি, তাঁরা যখন পারছেন, অন্যদেরও সুযোগ করে দিলে তাঁরাও নিশ্চয় পারবেন। গ্রামের স্কুলের ওই ছোট মেয়েগুলোও নিশ্চয় হয়ে উঠতে পারবে উদ্যোক্তা। সুযোগ তৈরি করা গেলে নানামুখী ভূমিকা ও ব্যবসার মূলধন পেলে এসব মেয়ে হয়ে উঠতে পারে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাওয়ার সৈনিক।

এত অগ্রযাত্রার পরেও মাঝে মাঝে শঙ্কিত হই নারীর প্রতি অসম আচরণ ও নির্যাতন দেখে। আবার যে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তিত, সেই নারীরাই তো আজ দায়িত্ব নিয়েছেন অন্যদের নিরাপত্তা বিধানের কাজে। পুলিশ, আনসার, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতেও আজ নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। আজ বাংলাদেশের নারী পুলিশ বাহিনী হয়ে উঠছে জাতিসংঘের শান্তি মিশনের অন্যতম অংশ।

আজ আমাদের নারীরাই অন্যের দায় নিয়েছেন। যেখানে এতভাবে নারীকে এগিয়ে যেতে দেখি, সেখানে আর একটুখানি সচেতনতা, ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা নিলে আমরা সবাই নিশ্চয়ই বন্ধ করতে পারি তনু ও অন্য নারীদের প্রতি সহিংসতা। নিশ্চয়ই এগিয়ে যেতে পারবেন আরও আরজু। যেসব ছাত্রী দলে দলে স্কুলে যাচ্ছে, তারাই হয়ে উঠবে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি আর শক্তি জোগাবে তাদের মতো অন্যদেরও জেগে উঠতে। ঢাকা শহরকে আর কেউ বলবে না খারাপ শহর।

ফেরদৌসি সুলতানা: সামাজিক উন্নয়ন ও জেন্ডার িবশেষজ্ঞ