রুপালি বিপ্লব

প্রজননক্ষেত্র রক্ষায় কড়াকড়ির সুফল হিসেবে এখন মৌসুমে বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে। ছবি: প্রথম আলো
প্রজননক্ষেত্র রক্ষায় কড়াকড়ির সুফল হিসেবে এখন মৌসুমে বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে। ছবি: প্রথম আলো

যে মাছ লোনাপানি ও মিঠাপানিতে সমানভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে, যে মাছ স্রোতের প্রতিকূলে দিনে গড়ে ৭২-৭৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়, সেটা আমাদের জাতীয় মাছ, সব মাছের সেরা, মাছের রাজা ইলিশ।

ইলিশ বাঙালি জাতির কৃষ্টি ও ঐত্যিহের প্রতীক। এর স্বাদ আর গন্ধ কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শুধুই কি স্বাদ আর ঐতিহ্য? পুষ্টিগুণেও এই মাছ অনন্য। এতে আছে ওমেগা-৩ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড, যার কারণে ইলিশ খেলে মানুষের শরীরে চর্বি জমে না, বরং রক্তকে কোলেস্টেরলমুক্ত করতে সাহায্য করে। এ মাছের আমিষে আছে ১০ ধরনের অতি জরুরি অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা মানুষের পাকস্থলী উৎপাদন করতে পারে না।

ইলিশ আদিকাল থেকেই এ অঞ্চলের অভিজাত মাছ। তবে আজকের দিনে রুপালি ইলিশ অনেক সহজলভ্য হয়েছে, আমজনতার ক্রয়ক্ষমতার নাগালে এসেছে। আজকে সেটির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ পাওয়া গেছে। সার্বিকভাবে আমরা এখন ইলিশ নিয়ে সত্যি গর্ব করতে পারি।

বিগত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে মোট মাছ উপাদন হয় ৩৮ দশমিক ৭৮ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৩ দশিমক ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। তার মানে ইলিশের উৎপাদন মাছের মোট উপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ। একক প্রজাতি হিসেবে এর অবদান সর্বাধিক। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি ১০০ পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে ইলিশ তার একটি। মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে এর অবদান প্রায় ১ শতাংশ। আজ ইলিশের জিআই হয়েছে। এর মূল্য আরও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে আমাদের দায়িত্বও। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরবে এই ইলিশ।

প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে সরাসরি ও প্রায় ২৫ লাখ মৎস্যজীবী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ইলিশ সম্পদের ওপর নির্ভর করে আছে তাদের জীবন-জীবিকার জন্য।

১৯ অক্টোবর আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন আমি ভাসছি মেঘনা মোহনায় ভোলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটারব্যাপী ঢেউতাড়িত এলাকায়। ইলিশ নিয়ে এক গবেষণার জন্য আমি জাহাজে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি ঢলচর, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীর চর ও কালির চরাঞ্চলে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ পেটে ডিম নিয়ে উজান ঠেলে উঠে যাচ্ছে মিঠাপানিতে ডিম ছাড়ার জন্য। তাদের পথে পথে শত বাধা আর বিপত্তি। তাদের পেটে কমপক্ষে ১০-১২ লাখ ডিম। মনে হয় পানির নিচে চলমান ইলিশ উৎপাদন কারখানা। নানা ধরনের শত্রুকে উপেক্ষা করে শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে তাদের। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে থমকে গেলে চলবে না। প্রজননক্ষেত্র (অভয়াশ্রম) অতিক্রম করে ইলিশের পাঁচটি অভয়াশ্রম চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার, মেঘনা মোহনায় শাহাবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া নদী, আন্ধারমানিক নদী, শরীয়তপুর অঞ্চলে পদ্মা নদীসহ আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চল অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নদীসমূহ যেমন: মহানন্দা, তিস্তা এমনকি হাকালুকি হাওর পর্যন্ত চলে যেতে হবে।

ইলিশের উৎপাদন বাড়ছেই। কয়েকজন জেলে বললেন, এবার যে পরিমাণ ইলিশ তাঁরা ধরেছেন, তাতে আগামী এক বছর ইলিশ না ধরলেও সংসার চলবে। গত বছরও তাঁরা এ কথা বলেছিলেন। ১ থেকে ২২ অক্টোবর ২২ দিন (পূর্ণিমার আগের ৪ দিন + পূর্ণিমার ১ দিন + অমাবস্যার দিনসহ ১৭ দিন) মা ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা মান্য করা তাঁদের জন্য সহজ হয়েছে। তবে কিছু কিছু লোভী ও অসৎ মৎস্যজীবী আইন অমান্য করে পেটে ডিমভর্তি ইলিশ ধরে ইলিশের প্রজননকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে দেখলাম। গবেষক দলের চোখের সামনে সে দৃশ্য ছিল খুবই বেদনাদায়ক।

ইতিমধ্যে কার্টুন বেরিয়েছে, একটি ইলিশ অপর একটি মা ইলিশকে বলছে, ‘আর বেশি ডিম ছাড়িস না, আমরা মনে হয় সস্তা হয়ে যাচ্ছি।’

ইলিশ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, বিপণন এই অবস্থায় আনার পথ এত মসৃণ ছিল না। অনেকের সম্মিলিত চেষ্টা এর পেছনে কাজ করেছে।

আমার ইলিশ গবেষণা জীবনের এক যুগের মাথায় ২০০০ সালের দিকে ইলিশ উৎপাদন যখন কমতে কমতে ২ লাখ মেট্রিক টনের নিচে চলে এল, তখন কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো মূলত নির্বিচারে ইলিশের পোনা বা জাটকা নিধনকে। এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেল যে ওই সময়ে যে হারে জাটকা নিধন হয়েছিল, তার শতকরা প্রায় ১৫ শতাংশও যদি রক্ষা করা যায় এবং পাঁচ বছর এটা করা যায়, তাহলে যে ইলিশ অতিরিক্ত উৎপাদন হবে, তা বিক্রি করে একটা পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২০০১ সালে হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান (এইচএফএমএপি) প্রণয়ন হয়। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন মৎস্য অধিদপ্তর এটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করলেও এবং তাতে ইলিশ উৎপাদন ক্রমেই কিছুটা বাড়লেও সেটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছিল না। ২০০৭-০৮ সাল থেকে মা ইলিশ ধরার ওপর ১০ দিনের (১৫-২৪ অক্টোবর) নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং মার্চ-এপ্রিলে জাটকার অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন—এই দুটি যুগান্তকারী উদ্যোগ পুরো ছবিটা বদলে দিতে শুরু করে। তা ছাড়া ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়টুকু সরকারি সহায়তা হিসেবে জেলেদের দেওয়া ভিজিএফ, বিকল্প কর্মসংস্থান, কারেন্ট জাল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি পদক্ষেপ আরও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এভাবে সর্বমহলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজকে ইলিশের এই বিপ্লব।

প্রতিবার চেষ্টায় ইলিশপ্রাপ্তি বা ‘ক্যাচ পার ইউনিট অ্যাফোর্ট’ (সিপিইউই) এখন অনেক বেড়ে গেছে। শুধু তা-ই না, ইলিশের সুষম উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইলিশের আকার বড় হয়েছে, পরিমাণে বেড়েছে এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ইলিশের আবাসস্থল বেড়ে গেছে। ২০১২ সালে এক অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখা যায়: জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়েছে পদ্মা-মাওয়া অঞ্চলে। অর্থাৎ ২০১২ সাল থেকে পদ্মা নদীতে আবার ইলিশ আসতে শুরু করে। রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট অঞ্চলে ইলিশ দেখা দেয়। অর্থাৎ ইলিশ তার আদি আবাসস্থলে ফিরতে শুরু করেছে।

এই বিরল দৃশ্য গবেষক, মৎস্যজীবী, প্রচারমাধ্যম তথা সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মহলের কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত দুই বছর ধরে বলেছেন, পয়লা বৈশাখে তাঁর মেনুতে কোনো ইলিশ থাকবে না। এ ধরনের প্রচারও অনেক কাজে লেগেছে। সার্বিকভাবে এইচএফএমএপির সঠিক বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ইলিশের উৎপাদনই শুধু বাড়েনি, ইলিশের বিশ্বে বাংলাদেশ উদাহরণ হয়েছে, মডেল হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভারত, মিয়ানমারসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ জানতে উদগ্রীব বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ যে বিশ্বে মৎস্য উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে, সেখানে ইলিশেরও বড় ভূমিকা আছে।

২০১২ সালের জুন থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ আছে। তবে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সীমিত আকারে ইলিশ রপ্তানি শুরু করা যায় কি না, এখন বোধ হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় কাঁটামুক্ত ইলিশ (স্যামন, টুনার মতো টিনজাত পণ্য) বা স্যুপ তৈরি করতে পারলে বিশ্ববাজারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হবে। ইলিশ পণ্যে ভ্যালু এডিশন কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। ইলিশের সঠিক মজুত নিরূপণ এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর সঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ডফিশ যুক্ত হয়েছে।

এ মুহূর্তে ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন এবং পুকুরে ইলিশ চাষের বাণিজ্যিক সফলতা নিয়ে গবেষণা চলছে। শৌখিন পর্যায়ে এটা এখনই সম্ভব।

ইলিশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশের নদ-নদীতে সাড়ে সাত হাজার বর্গকিলোমিটারের যে বিশাল প্রজনন অঞ্চল সংরক্ষণ করা হচ্ছে ২২ দিন ধরে, এ সময় ওই অঞ্চলে পানির নিচে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ অন্য সব প্রজাতিও সংরক্ষণ হচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হচ্ছে। দেশে এ কারণে সার্ডিন, চৌক্কা, চন্দনা, ইলিশসহ অন্য অনেক মাছের আধিক্য দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলসীমা জলজ সম্পদ, মৎস্য জাতীয় সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এটি এক বিরাট সাফল্যগাথা।

মো. আনিছুর রহমান: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট