রুখে দাঁড়ানোর গল্প

সারা দেশে একের পর এক অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা অনেকটাই পর্যুদস্ত। ছবি: সাজিদ হোসেন
সারা দেশে একের পর এক অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা অনেকটাই পর্যুদস্ত। ছবি: সাজিদ হোসেন

প্রায় দেড় বছর আগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও কূটনৈতিক পাড়া বলে পরিচিত গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারি নামক এক রেস্তোরাঁয় রাতের প্রথম প্রহরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তার পেছনে ছিল দেশেরই জঙ্গি ভাবধারার কিছু তরুণ। তাদের সবাই ছিল উচ্চশিক্ষিত এবং সচ্ছল পরিবারের সন্তান। এটিই ছিল এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। এতে ওই রেস্তোরাঁয় আসা দেশি-বিদেশি ২০ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। তা ছাড়া হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে গিয়ে দুজন পুলিশ সদস্যও নিহত হন। বিদেশিদের মধ্যে সিংহভাগ জাপানি আর ইতালীয় নাগরিক ছিলেন। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এত বড় জঙ্গি হামলার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হামলাকারীরাও সবাই মারা গিয়েছিল পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর অভিযানে। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশ বা জাপান বা ইতালিকে নয়, গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। অপ্রস্তুত ছিল সরকার। এই জঙ্গি হামলা জঙ্গি দমনে সরকারের চিন্তাধারা বদলে দেয়।

এই হামলা ছিল রাষ্ট্রের ওপর এক বিশাল আক্রমণ। এতে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও বর্তমান সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। এই হামলার পেছনে যারা ছিল, তারা নিজেদের আইএসের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়েছিল। পরে জানা যায়, এরা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির একাংশ, যাদের নব্য জেএমবি বলে আখ্যায়িত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হোলি আর্টিজানের পরপরই শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দানে হামলার প্রচেষ্টা রুখে দিতে সক্ষম হয়েছিল কর্তব্যরত পুলিশ।

অবশ্য এই হামলাগুলোর আগে বেশ কিছু ব্লগার ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের পেছনে একই সংগঠনের জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা ছিল। তবে গুলশানে হামলার পরই সরকার জঙ্গি দমনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। ওই হামলার পর জঙ্গি দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বেগ পায়। জঙ্গি দমনে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। প্রতিক্রিয়া (রিঅ্যাকটিভ) নীতি থেকে ক্রমেই বর্তমান সরকার ক্রিয়াশীল (প্রো-অ্যাকটিভ) কৌশল গ্রহণ করে এবং এই উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নতুন আঙ্গিকে প্রস্তুত করা হয়। এ ঘটনার মাত্র মাস চারেক আগে জঙ্গি দমনে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট গঠন করা হয়েছিল। সেটিকে ব্যাপকভাবে সক্রিয় করা হয়। শুরুতে সেটা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি ইউনিট ছিল। এ বছর পুলিশের একটি স্বতন্ত্র ইউনিট চালু হয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাবের সক্ষমতাও বেড়েছে। একই খাতে ‘সোয়াট’ নামের বিশেষ বাহিনীর ভূমিকাও লক্ষণীয়।

জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জামের ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ অতি অল্প সময়ের মধ্য সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে সরকারের সদিচ্ছা ও জোরালো ভূমিকা দৃশ্যমান। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সফল অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যার মধ্যে সর্ববৃহৎ অভিযান ছিল কল্যাণপুরে, সেখানে কথিত নব্য জেএমবির সদস্যরা আইএসের মতাদর্শী বড় ধরনের হামলার জন্য একত্র হয়েছিল। সোয়াট টিমের ওই অভিযানে নয়জন জঙ্গি নিহত হয়।

আরও পরে আজিমপুর, মিরপুর, সিলেট, যশোরসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় সফল অভিযান চালানো হয়। সিলেটে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের অভিযানের অগ্রভাগে রাখা হয়েছিল। এতগুলো অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নারায়ণগঞ্জ শহরের অদূরে একটি আস্তানায় অভিযান। ওই অভিযানে মারা যান নব্য জেএমবি ও আইএস-ঘোষিত শীর্ষ নেতা কানাডাপ্রবাসী তামিম চৌধুরী। পুলিশের ভাষ্যমতে, তামিম চৌধুরীই ছিলেন হোলি আর্টিজান হামলার রূপকার। তবে এতগুলো সফল অভিযানের পরও নেতৃত্বে থাকা কোনো গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিকে জীবিত ধরা যায়নি। প্রায় সবাই আত্মঘাতী হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খবরে প্রকাশ।

তামিম চৌধুরী ও আরেক সহযোগীর মৃত্যু ছিল জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অন্যতম সফল ঘটনা। কারণ, তথ্যমতে কানাডাপ্রবাসী তামিম চৌধুরী হোলি আর্টিজান আর শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দানে হামলা প্রচেষ্টার পেছনের মূল পরিকল্পনাকারী। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে অবস্থান করলেও কীভাবে এত দিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পেরেছেন?

তামিম চৌধুরী ও তাঁর সহযোগী ‘নব্য জেএমবি’ বলে কথিত আইএসের ভাবাদর্শে লালিতদের মৃত্যু এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক সফল অভিযান জঙ্গি সংগঠনগুলোর সংগঠিত হওয়ার মতো ক্ষমতা একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পেরেছে বলে মনে হয়। এগুলো অবশ্যই বড় সফলতা। তবে এর সঙ্গে কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। এখন পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কথিত সামরিক কমান্ডার বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক ধরা পড়েননি। তেমনি আরও কিছু নেতৃস্থানীয় জঙ্গি রয়েছেন পলাতক।

জঙ্গি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এর কৃতিত্ব সরকারের শক্ত অবস্থান ও জিরো টলারেন্স নীতির। তবু আমরা কি সম্পূর্ণভাবে শঙ্কামুক্ত হয়েছি? উত্তর হলো, আতঙ্কমুক্ত হলেও শঙ্কামুক্ত হতে পারিনি আমরা এখনো। এর অন্যতম কারণ, এ ধরনের জঙ্গি তৎপরতা সহজে সমূলে উৎপাটিত হওয়ার নজির কোথাও নেই। তবে এদের পরাহত করা যায়। এ জন্য শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি যেসব সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলোতেও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। জনসচেতনতা বেড়েছে। তবে যথেষ্ট নয়।

জঙ্গি তৎপরতা বর্তমানে বৈশ্বিক বিষয়। তবে যেসব জায়গায় জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান, সেখানে এ ধরনের উত্থানের বড় ধরনের কারণ ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। বিশ্বে আল-কায়েদার উত্থানের পেছনে যেমন আছে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তথাকথিত ইসলামপন্থী কট্টরবাদীদের বিবাদ, তেমনি আইএসের উত্থানের পেছনে ইরাক ও সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, গণতন্ত্রের অভাব ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব জঙ্গি উত্থানের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। হয়তো অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আইএস তাদের ঘাঁটি থেকে উৎখাত হবে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে এদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে সিরিয়া ও ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে আল-কায়েদার শক্তি সঞ্চয় জঙ্গি তৎপরতার নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। আইএসের সম্পূর্ণ পরাজয়ের পর সিরিয়ায় আল-কায়েদার শক্তি বৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশ যে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা নেই।

বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার ক্ষেত্র হলো, মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ওই দেশের সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত গণহত্যা এবং প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে ছোট একটি জায়গায় বিশাল ক্যাম্পে অবস্থান। তাদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৫০০ এতিম শিশু রয়েছে, যারা ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে জঙ্গি সংগঠনগুলোর জোগান। তা ছাড়া মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন অঞ্চলে আইএস বা আল-কায়েদার বিচরণক্ষেত্র তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনটা হলে পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও সুখকর হবে না। রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘ মেয়াদের হলে এটি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকেই।

তবু এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে সরকারের জঙ্গিবিরোধী কড়া অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। তবে আত্মতৃপ্তির তেমন সুযোগ নেই, যত দিন পর্যন্ত ‘রোহিঙ্গা’ সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান না হয়।

জঙ্গি দমনের অন্যতম হাতিয়ার সমাজে সচেতনতা এবং এদিকেই বর্তমানে নজর দেওয়া উচিত। এখানে এখনো আশান্বিত সফলতা তেমন দৃশ্যমান নয়। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সমাজের মধ্যে বিভাজন কমাতে হবে। বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে, যেখানে কোনো গোত্র বা ধর্মের বিভাজন নেই, সে দেশে এ ধরনের জঙ্গি উত্থানের কারণ আজও স্পষ্ট নয়। এর কারণ খুঁজে না পেলে সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।

এম সাখাওয়াত হোসেন: নিরাপত্তা বিশ্লেষক