ভীতি থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না কোচিং-প্রাইভেট

কোচিং–প্রাইভেটের জন্য ব্যবহৃত ধানমন্ডি গভ: বয়েজ হাইস্কুলের কিছু শিক্ষকের ফেরত দেওয়া চেয়ার–টেবিলগুলো স্কুলের ভেতরে রাখা হয়েছে। ছবিটি গত রোববার তোলা l প্রথম আলো
কোচিং–প্রাইভেটের জন্য ব্যবহৃত ধানমন্ডি গভ: বয়েজ হাইস্কুলের কিছু শিক্ষকের ফেরত দেওয়া চেয়ার–টেবিলগুলো স্কুলের ভেতরে রাখা হয়েছে। ছবিটি গত রোববার তোলা l প্রথম আলো

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎপরতার পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাইভেট ও কোচিং করেন, এমন শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি শুরু হয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষক প্রাইভেট বন্ধ করে দিয়ে চেয়ার-টেবিল বিদ্যালয়ে ফেরত দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার প্রাইভেটের পরিধি সীমিত করছেন। তবে এত কিছুর পরও অনেক শিক্ষক এখনো প্রাইভেট ও কোচিং-বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এবং শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

কয়েক মাস ধরে দুদক রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়াভাবে প্রাইভেট ও কোচিং করান এমন শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহে মাঠে নামে। এরপর থেকেই ওই সব শিক্ষকের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়।

এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জারি করলেও বাস্তবে সেটা কখনো মানা হয়নি। বেশির ভাগ শিক্ষকই হরেদরে কোচিং-প্রাইভেট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১২ সালের ওই নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষকেরা তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে দিনে অন্য প্রতিষ্ঠানের সীমিত সংখ্যক (১০ জনের বেশি নয়) শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন।

এর মধ্যেই ১ নভেম্বর দুদকের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ২৪টি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষক ১০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ বছর পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের অনেকে একই কর্মস্থলে বছরের পর বছর থাকার ফলে প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। দুদক ১০ বা তার অধিক সময় ধরে যেসব শিক্ষক একই প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন, তাঁদের বিভাগের বাইরে বদলি করার সুপারিশ করে। এর আগে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে দুদক, যেগুলো সরকারের কাছে জমা আছে।

তবে একাধিক শিক্ষক বলেছেন, দুদকের তালিকা ধরে সবাইকে কোচিংবাজ বলে ঢালাওভাবে যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না।

দুদকের তালিকায় রাজধানীর ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের ১৭ জন শিক্ষক রয়েছেন। গত রোববার সরেজমিনে গেলে একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, এই তালিকা প্রকাশের আগেই দুদক যখন তৎপরতা শুরু করে তখনই প্রাইভেট ও কোচিং করান এমন শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি শুরু হয়। এর মধ্যেই কয়েকজন শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর জন্য যেসব চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করতেন, সেগুলো বিদ্যালয়ে ফেরত দিয়েছেন। সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মূল ভবনের নিচতলার এক পাশে ফেরত দেওয়া চেয়ার-টেবিলগুলো রাখা হয়েছে।

একই দিনে ধানমন্ডির গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে গিয়েও শিক্ষকদের ভীতির বিষয়টি বোঝা গেল। দুদকের তালিকায় এই বিদ্যালয়ের ৩২ জন শিক্ষকের নাম রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, আগে যত ব্যাচে শিক্ষার্থী পড়াতেন এখন সেটা করবেন না। এখন সীমিত পর্যায়ে পড়াবেন।

এ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বড় ব্যাচে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। ইংরেজির বিষয়ের এমন একজন শিক্ষক আজিমপুরে চায়না বিল্ডিং গলি এলাকায় একসঙ্গে অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়ান। এমন আরেকজন শিক্ষক আছেন, যিনি গ্রিন রোড এলাকার ভোজন রেস্তোরাঁর কাছে একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীকে পড়ান। এক শিক্ষার্থীর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ওই শিক্ষক জানুয়ারি থেকে আর এত শিক্ষার্থী পড়াবেন না বলে জানিয়েছেন।

সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে কলেজ স্ট্রিট গলিতে কোচিংয়ের হাট বসে। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী এবং ভর্তি কোচিংগুলো এখনো সক্রিয়। তবে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী কম দেখা গেছে। এর মধ্যেও কেউ কেউ সেখানে পড়াচ্ছেন।

বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতেও এর প্রভাব পড়ছে। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষক গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক চেয়ার-টেবিল গুছিয়ে ফেলছেন।

একই দিনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গেলে অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা করতে দেখা গেছে। একজন অভিভাবক বললেন, আতঙ্ক শুরু হলেও এখনো কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামানের ভাষ্য, তাঁরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনটি পাস হলে কোচিং-প্রাইভেট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।