শিক্ষকের পরে এবার প্রকাশক

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক মোবাশ্বার হাসান (সিজার) নিখোঁজের পরদিনই গত বুধবার ভোরে গুলশানের বাসা থেকে সাদাপোশাকের লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে এক প্রকাশনা ব্যবসায়ীকে। করিম ইন্টারন্যাশনাল নামে ওই প্রকাশনা সংস্থাটির কর্ণধার তানভীর ইয়াসিন করিমকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি মোবাশ্বার হাসানেরও।
এ নিয়ে গত আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে গতকাল পর্যন্ত ১০ জন নিখোঁজ হলেন। বিগত বছরগুলোতে নিখোঁজ বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিলেন সন্দেহভাজন অপরাধী, বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে গত দুই মাসে নিখোঁজের প্রবণতা ভিন্ন। এই তালিকায় রয়েছেন ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, পৌর মেয়র, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র, ছোট রাজনৈতিক দলের নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও প্রকাশক। নিখোঁজের নতুন এ প্রবণতায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে সমাজের সর্বস্তরে।
এই উদ্বেগের মধ্যেই গতকাল বেলা দেড়টার দিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার প্রখ্যাত গেরিলা গ্রুপ ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য হাবিবুল আলম বীর প্রতীককে তাঁর ইস্কাটনের কার্যালয় থেকে তুলে নেওয়া হয়। এ খবর দ্রুত ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। হাবিবুল একটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আইএসএনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আইএসএনের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাদাপোশাকের একদল লোক নিজেদের ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দিয়ে হাবিুবলকে নিয়ে যায়।
সন্ধ্যায় র‍্যাব জানায়, হাবিবুলকে তারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে এসেছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। র‍্যাব-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম রাতে প্রথম আলোকে বলেন, হাবিবুল আলমকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আফ্রিকার একটি প্রতারক চক্রকে নিয়ে র‍্যাব তদন্ত করছে। সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাঁকে আনা হয়েছিল।
এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষক মোবাশ্বারের নিকটজনদেরও সন্দেহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান। একই সঙ্গে তিনি সরকারের এটুআই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিভাগের সমন্বয়ক। যুক্তরাজ্য ও কানাডা থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া এই শিক্ষক এটুআই প্রকল্পের সভায় যোগ দিতে মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনে যান। সেখান থেকে বের হওয়ার পরই তিনি নিখোঁজ হন।
এ বিষয়ে মোবাশ্বারের বাবা মোতাহার হোসেন খিলগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। তবে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো খবর পাইনি। ডিবিও তদন্ত করছে, আমরাও দেখছি।’
সর্বশেষ মুঠোফোনে যার সঙ্গে মোবাশ্বারের কথা হয়েছে, তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে জানাচ্ছে পুলিশ। অথচ গত বছর থেকে দেশের সব সিম কার্ড বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিবন্ধনের কারণে মুঠোফোনের নম্বরের মালিকের পরিচয় বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়। পুলিশ এ ক্ষেত্রে কেন মুঠোফোন নম্বরের মালিকের পরিচয় খুঁজে পায় না, তা বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে খিলগাঁও থানার ওসি বলেন, ‘ওটা (ওই ফোনটি) বন্ধ এখনো। কোনো উল্লেখযোগ্য ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না।’ মোবাশ্বারের বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমেন্টস করার মতো কোনো অগ্রগতি নাই। তদন্ত করছি।’

মোবাশ্বারের বাবা গিয়েছিলেন র‍্যাব-৩-এর কাছেও। র‍্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি। ওদের পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আজকে (গতকাল) আবার আমরা তাঁর বাবাকে ডেকেছিলাম। তা ছাড়া যেখানে তাঁর শেষ অবস্থান দেখিয়েছে, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস, সেখানেও সাদাপোশাকে আমরা আমাদের টিম পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।’

>মোবাশ্বারের নিকটজনদের সন্দেহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে তুলে নিয়ে যেতে পারে

মোবাশ্বারের চাচা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো মনজুর হোসেন গতকাল তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি জানি না, সিজার (মোবাশ্বার) কী কারণে এবং কার বিরাগভাজন হয়েছেন? গবেষণা বা লেখালেখিতে ভিন্ন মতামত থাকতেই পারে এবং তা কারও মনঃপূত হতেও পারে বা নাও পারে। কিন্তু একাডেমিক ডিসকোর্সে সবাই তা মেনে নেয়। কারণ তা শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চাকেই সমৃদ্ধ করে।’

এদিকে মোবাশ্বারের ফেসবুক মেসেঞ্জার কিছুক্ষণ পরপর খোলা পাওয়া যাচ্ছে বলে তাঁর কিছু বন্ধু ও স্বজন ফেসবুকে লিখেছেন। তাঁরা বলছেন, মোবাশ্বার নিখোঁজের ঘটনায় তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। গত বুধবার ও গতকাল ওসব বার্তা ‘সিন’ (দেখা) হয়েছে। অর্থাৎ নিখোঁজ হওয়ার পরেও তাঁর মেসেঞ্জার কেউ খুলেছিল বলে তাঁরা ধারণা করেছেন।

ভ্যান নিয়ে পুলিশও এসেছিল, তবু কেউ কিছু জানে না

করিম ইন্টারন্যাশনাল ও দারুস সালাম পাবলিকেশনস নামের প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার তানভীর ইয়াসিন করিমদের বাড়ি গুলশান ২ নম্বরের ৫১ নম্বর সড়কে, গুলশান থানার পেছনে। অভিজাত ওই অ্যাপার্টমেন্টে সিসি ক্যামেরা, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রহরী, ইন্টারকম যোগাযোগসহ সব রকমের নিরাপত্তা প্রস্তুতি রয়েছে। ওই ভবনে আগন্তুকদের ঢুকতে হলে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে পরিচয় দিয়ে ও অনুমতি নিয়েই ঢুকতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল তাঁর বাসায় গেলে পরিবারের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। বাসার অভ্যর্থনা থেকে ইন্টারকমে দুজন নারী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা বলেন, তানভীরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁদের কিছু বলা হয়নি।

ওই বাসার একজন নিরাপত্তাকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার ভোর ছয়টার দিকে একটি সাদা হাইএস মাইক্রোবাস এবং একটি পুলিশের পিকআপ ভ্যানে করে সাদাপোশাক ও পুলিশের পোশাক (ইউনিফর্ম) পরা ৩০-৩৫ জন আসেন। তাঁরা তানভীরকে তাঁর বাসা থেকে নিয়ে যান।

নিরাপত্তাকর্মীরা এমন তথ্য দিলেও গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। তানভীর নামের কাউকে তাঁরা গ্রেপ্তার বা আটক করেননি।

তানভীর ইয়াসিন করিমদের রাজধানীর মণিপুরিপাড়ায় বইয়ের দোকান রয়েছে। করিম ইন্টারন্যাশনাল বই প্রকাশের পাশাপাশি বিদেশি বিভিন্ন লেখকের বই চাহিদামতো বিদেশ থেকে এনে সরবরাহ করে থাকে।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশকে সরাসরি দোষারোপ

বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী এবং একই দলের কেন্দ্রীয় নেতা আশিক ঘোষকে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা ‘তুলে নিয়েছে’ বলে অভিযোগ তাঁদের পরিবারের। গতকাল বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এমন অভিযোগ করেন।

সংবাদ সম্মেলনে মিঠুন চৌধুরীর স্ত্রী সুমনা চৌধুরী, আশিক ঘোষের মা সন্ধ্যা রানী ঘোষ ও স্ত্রী সতী রানী ঘোষ বক্তব্য দেন। ২৭ অক্টোবর মিঠুন ও আশিককে সূত্রাপুর থানা এলাকার ফরাশগঞ্জের প্রিয় বল্লভ জিউ মন্দির ফটকের পাশ থেকে একটি কালো গাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আটক করে নিয়ে যান।

সুমনা চৌধুরী ও সতী রানী ঘোষ দাবি করেন, এ ঘটনায় থানা-পুলিশ নিখোঁজের কোনো সাধারণ ডায়েরি নেয়নি। তারা বলেছে, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে যোগাযোগ করলে দুজনের সন্ধান মিলতে পারে। এ জন্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অফিসের সামনে গেলেও তাঁরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

তবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম বলেন, তাঁরা তো জঙ্গি নন। এ ধরনের কাউকে আটকের কোনো প্রশ্নই আসে না।

দুই ভাইয়ের একজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে র‍্যাব

গত মঙ্গলবার সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেলে করে বেরিয়ে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী দুই ভাই আসাদুজ্জামান ও ফয়সাল রহমান। এ বিষয়ে আসাদুজ্জামানের স্ত্রী তানজিনা সাঈদ খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তানজিনা গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁর স্বামী আসাদুজ্জামান বাসায় ফিরেছেন। আর দেবর ফয়সাল রহমানকে একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

পরে জানা গেছে, ফয়সালকে জঙ্গি দলের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে র‍্যাব।

আসক ও সুজনের বিবৃতি

শিক্ষক মোবাশ্বার হাসানের নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গতকাল পাঠানো এক বিবৃতিতে মোবাশ্বারসহ সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার এবং ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়েছে আসক।

সুজনের বিবৃতিতে বলা হয়, নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং তাঁদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া; একই সঙ্গে যারা এসব ভয়াবহ কর্মকাণ্ডে যুক্ত, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।