মানুষের আস্থার হাসপাতাল

জনির বয়স ২১ বছর। বাসা নারায়ণগঞ্জে। গতকাল শুক্রবার সকালে দুর্ঘটনায় তাঁর ডান হাত কেটে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জরুরি বিভাগের রিসাসসিটেশন রুমে জনির অস্ত্রোপচার চলছিল। বাইরে জনির মা অপেক্ষা করছেন। চোখে পানি। এত দূর, এই হাসপাতালে এসেছেন কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে জনির মা বললেন, ‘আইজ তো শুক্কুর বার, ছুটির দিন। কই যামু। আর এইডা তো বেবাগ দ্যাশের মইধ্যে হবচেয়ে ভালা হাসপাতাল।’

নতুন ভবন বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-২-এর দোতলায় দুপুর ১২টার সময় সিঁড়ির সামনে মাদুর পেতে শুয়ে ছিলেন এক প্রৌঢ়। নোয়াখালী থেকে আসা এই প্রৌঢ় জানালেন, তাঁর স্ত্রী ইউরোলজি বিভাগে ভর্তি ২০ দিন ধরে। মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষ থাকতে পারে না বলে এই বারান্দাতেই তাঁর দিন-রাত কাটছে। তিনি বললেন, ‘এখানে বড় বড় অনেক ডাক্তার। সব সময় ডাক্তার পাওয়া যায়।’

জরুরি বা জটিল রোগের চিকিৎসায় সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা মনে করেন, ছয়টি বিষয় ঢাকা মেডিকেলকে অন্য হাসপাতাল থেকে আলাদা করেছে। প্রথমত এর বিশালত্ব। বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এখানে সাধারণ রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহু শাখায় বিশেষায়িত সেবা দেওয়া হয়। ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা চালু থাকে এখানে। প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে এই হাসপাতালে। আছে বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো দক্ষ জনবল। ঢাকা মেডিকেলের স্নায়ুরোগ বিভাগের অধ্যাপক মনসুর হাবীব কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘রোগী এলেই ভর্তি করি। শয্যা নেই বলে কাউকে ফিরিয়ে দেই না। চিকিৎসা পাওয়া যাবেই—এই বিশ্বাসে মানুষ আসে।’ এই শীর্ষ প্রতিষ্ঠানটি আজ ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করবে।

 রোগীর চাপ

সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে অথবা লিফটে চড়ে নতুন ভবনের পাঁচতলায় পৌঁছালে মনে হবে শরণার্থীশিবির। মেঝেতে ঠাসাঠাসি করে মানুষ শুয়ে আছে। প্রত্যেক শয্যার পাশে থালা-ঘটি-বাটি-বালতি, পানির বোতল। আছে বালিশ, ব্যাগ, কাঁথা-কম্বল, হাতপাখা। অনেকেরই শিরায় স্যালাইন চলছে। এটা মেডিসিন বিভাগের মহিলা ওয়ার্ডের বাড়িয়ে নেওয়া অংশ। মূল ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এখানে রেখে রোগীদের চিকিৎসা চলছে।

হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই বিভাগে শয্যাসংখ্যা ৫৬০টি। কিন্তু গড়ে দৈনিক রোগী ভর্তি থাকে প্রায় এক হাজার। সারা বছরই এই চাপ। গত বছর এই একটি বিভাগেই ৬০ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছে।

রোগীর চাপ পুরো হাসপাতালে। এই হাসপাতাল ২ হাজার ৪০০ শয্যার। কর্তৃপক্ষ বলছে, গড়ে দৈনিক ভর্তি থাকে সাড়ে ৩ হাজার রোগী। বহির্বিভাগে দৈনিক ৫ হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয় ১ হাজার। মাঝারি থেকে বড় অস্ত্রোপচার হয় দৈনিক ২০০টি।

কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দেশের অন্য কোনো হাসপাতাল যে রোগ ধরতে পারেনি, ঢাকা মেডিকেল তা নির্ণয় করতে পেরেছে। অন্য হাসপাতাল যাকে চিকিৎসা দিতে চায়নি, ঢাকা মেডিকেল তাকে ফেরায়নি। এটাই ঢাকা মেডিকেলের ঐতিহ্য।’ বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক সার্জন হোসাইন ইমাম বলেন, এই হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি বিভাগে দেশের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকেরা কাজ করেন।

 দিনরাত সেবা

খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বা সরকারি ছুটির দিন, হরতাল-অবরোধ কোনো কিছুতেই জরুরি বিভাগ বন্ধ থাকে না। বছরের ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগ খোলা থাকে। মানুষ এখানে আসলে ডাক্তার পাবেই।’

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে দৈনিক গড়ে এক হাজার মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। একসঙ্গে বহু মানুষের চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য এই হাসপাতালের আছে। উদাহরণ হিসেবে হোসাইন ইমাম পুরান ঢাকার নিমতলীর রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার ঘটনার উল্লেখ করেন। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ঘটনার পরপরই আগুনে পোড়া দুই শতাধিক মানুষকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছিল।