ছোট, তবে আধুনিক হচ্ছে সনি

সনি সিনেমা হল ভবন নানা রকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঠাসা। খাবারের দোকান থেকে শুরু করে জুতা, পোশাকের দোকান—এ ভবনে সবই আছে। ছবি: প্রথম আলাে
সনি সিনেমা হল ভবন নানা রকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঠাসা। খাবারের দোকান থেকে শুরু করে জুতা, পোশাকের দোকান—এ ভবনে সবই আছে। ছবি: প্রথম আলাে

মিরপুর ১ নম্বর চত্বর থেকেই দেখা গেল সনিকে। সুউচ্চ ভবনের ওপরে বড় করে লেখা ছোট নাম সনি। এ প্রতিষ্ঠানের পোশাকি নাম সনি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড। রাজধানী মিরপুর এলাকায় টিকে থাকা তিনটি সিনেমা হলের মধ্যে এটি অন্যতম।

সনির খোঁজ নিতে মিরপুরে যাওয়া। রাস্তার যে মোড়ে সনির অবস্থান, ওই মোড়কে ‘সনির মোড়’ হিসেবেই চেনে গণপরিবহনের কর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় ব্যক্তিরা। দূর থেকে সনির সাইনবোর্ড চোখে এলেও সামনে গিয়ে একটু ধাক্কা খেলাম। শুধু সিনেমা হল হিসেবে পরিচিত এই ভবন নানা রকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঠাসা। খাবারের দোকান থেকে শুরু করে জুতা, পোশাকের দোকান—এ ভবনে সবই আছে।

সনি সিনেমা হলে ঢোকার মুখে দেখা হলো প্রতিষ্ঠানটির মালিক চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে। ভেতর থেকে ভেসে আসছিল ঠুকঠুক আওয়াজ। সংস্কারকাজ চলছে। মোহাম্মদ হোসেন জানালেন, নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সনিকে। এখন থেকে মাল্টিপ্লেক্সের মতো করে চলবে। থাকবে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।

মোহাম্মদ হোসেনই জানালেন সনির বিস্তারিত। আড়াই বিঘা জমিতে ১৯৮১ সালে সনির নির্মাণকাজ শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর কাজ চলে। ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট লড়াকু ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়।

উদ্যোক্তা মোহাম্মদ হোসেনের বড় মেয়ের নাম সনি। তাঁর নামেই হলের নাম। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু ৫০ জন কর্মী নিয়ে। বর্তমানে কর্মী আছেন ৩০ জন। শুরুর দিকের কর্মী আছেন অল্প কয়েকজন। তাঁদেরই একজন আবদুস সামাদ। সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করছেন। ৩০ বছরের বেশি সময় কাজ করা আবদুস সামাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এ প্রতিষ্ঠান শুধু তাঁর চাকরির জায়গা নয়, আবেগও জড়িত। শুরুর দিনের কথা মনে আছে স্পষ্ট। বললেন, লড়াকু সত্যি সত্যি লড়াই বাঁধিয়ে দিয়েছিল। ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল ১ হাজার ১০০ মানুষ। বাইরে অপেক্ষায় ছিল বিপুল মানুষ।

বেশ ঘটনাবহুল ছিল সনির উদ্বোধন। স্থানীয় সংসদ সদস্যকে উদ্বোধনে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে হুমকি-ধমকি-হামলা হয়। তবু থেমে থাকে না উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা। এসেছিলেন তখনকার জনপ্রিয় নায়ক উজ্জ্বল, নায়িকা অঞ্জনাসহ অনেকে। অঞ্জনা নেচেছিলেন। গান করেছিলেন কিরণ চন্দ্র রায়। বয়সে তরুণ হলেও ওই সময়ে সংগীতশিল্পী হিসেবে কিরণ চন্দ্র বেশ পরিচিতি ছিলেন।

শুরুর প্রথম দুই মাস লড়াকু ছবিটি চলে। সব শ্রেণির দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। শুরুর দিকে তিন শ্রেণিতে দর্শক যথাক্রমে ১৬, ১২ ও ৮ টাকায় টিকিট কেটে ঢুকত। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে চারটি শো চলত। দিনের প্রদর্শনীগুলোতে অপেক্ষাকৃত তরুণ বা শিক্ষার্থীরা বেশি আসে। সন্ধ্যার শোতে বেশির ভাগই পোশাকশ্রমিক এবং আশপাশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দর্শক হয়ে আসেন।

ঝিনুক মালা, বেদের মেয়ে জোছনা, আজকের হাঙ্গামা, অপহরণ, সত্যের মৃত্যু নেই, খায়রুন সুন্দরীর মতো ছবিগুলো দিনের পর দিন চলেছে সনি সিনেমা হলে। আবদুস সালাম জানান, ঝিনুক মালা ছবিটির প্রতিটি প্রদর্শনীই হাউসফুল ছিল।

প্রদর্শনীর পাশাপাশি চলচ্চিত্রে প্রযোজনায় ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। সনি কথাচিত্র এবং গ্রামীণ কথাচিত্র নামে অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অবুঝ দুটি মন, বাংলার কমান্ডো, বীর সন্তান, প্রিয়জন, মুক্তি চাই, রাঙ্গা বউ, লুটপাট, আজকের হাঙ্গামা, চাঁদের মতো বউ, নাম্বারওয়ান শাকিব খানসহ বেশ কিছু বাণিজ্যিক সফল ছবি রয়েছে।

কাউন্টারে টিকিট কাটছেন দর্শকেরা  l ছবি: প্রথম আলো
কাউন্টারে টিকিট কাটছেন দর্শকেরা l ছবি: প্রথম আলো

গতকাল শুক্রবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় বেশ ভিড় দেখা গেছে সনিতে। এদিন মুক্তি পেয়েছে নবাব ছবিটি। বৃহস্পতিবার ছিল ঢাকা অ্যাটাক। ছবিটি দুই সপ্তাহ আগে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। মাঝে ডুব ছবিটি চালানো হয়েছিল। তবে তেমন সাড়া মেলেনি। পুরোনো ছবির মধ্যে নবাব ছবিটির ভালো চাহিদা ছিল। সেই বিবেচনায় শুক্রবার আবার মুক্তি দেওয়া হয়েছে নবাব—জানালেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক বরুণ সরকার।

সংস্কারকাজ চলছে সনিতে। ১ হাজার ১০০ আসন নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা করেছিল, সেখানে এখন মাত্র ৫০০ আসন। একটাই দর্শক শ্রেণি—ডিসি। প্রবেশমূল্য ৮০ টাকা। আগে হল ছিল ভবনের নিচে, এখন চলে গেছে ওপরে—পঞ্চম তলায়। এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন মোহাম্মদ হোসেন। বললেন, ‘আধুনিক সুবিধাসহ পুরোপুরি সিনেপ্লেক্সের ধারণা নিয়ে চালু রাখার কথা ভাবছি।’

গতকাল দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, হল ভবনের বাইরের অংশের সাজসজ্জা পরিবর্তন এবং নানা রকমের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতিতে দর্শকের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে আসা তরুণ মোস্তফা মাহমুদ বলেন, ‘নবাব চলছে শুনে এখানে এসেছি। কিন্তু রিকশা থেকে নেমে একটা ধন্দে পড়ে গেলাম, হল বন্ধ হয়ে গেল নাকি! পরে ঢুকে দেখি হল ঠিকই আছে।’ একই রকম মন্তব্য পাওয়া যায় আরও কয়েকজন দর্শকের কাছ থেকে। তবে পল্লবী থেকে আসা রিপন বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘ছবি দেখার পাশাপাশি এখানে এসে দোকানে খেতে পাচ্ছি। চাইলে জামাকাপড়, জুতাও কেনা যায়। মন্দ কি!’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের একজন কর্মী বলেন, ‘সব শ্রেণির দর্শক ছিল আমাদের। তবে তুলনামূলক নিম্ন আয়ের দর্শক আস্তে আস্তে কমছে। অনেকে ভেতরে ঢুকতে অস্বস্তিবোধ করে। ভাবে, আমরা আধুনিক করে টিকিটের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি।’

বাংলা ছবির ব্যবসাও এখন মন্দা। এ সংকটে সনি ছোট হয়ে গেলেও টিকে তো থাকল!