দূষণ, আবর্জনার কবলে শীতলক্ষ্যা

নারায়ণগঞ্জ শহরের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। নদীর পাশের পায়ে চলাপথটিও আবর্জনায় ভরা। ছবিটি ৩ নভেম্বর বন্দর খেয়াঘাট থেকে তোলা l ছবি: হাসান রাজা
নারায়ণগঞ্জ শহরের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। নদীর পাশের পায়ে চলাপথটিও আবর্জনায় ভরা। ছবিটি ৩ নভেম্বর বন্দর খেয়াঘাট থেকে তোলা l ছবি: হাসান রাজা

শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জ শহরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। শহরে নদীটির পাঁচটি ঘাটের পাশ দিয়ে লোকজনের চলাচলের জন্য নকশা করা টালি বিছিয়ে পথ তৈরি করা হয়েছে। নদীর ঢাল কংক্রিট দিয়ে বাঁধা। পায়ে চলা পথের পাশে খানিক পরপর বসার জন্য কংক্রিটের বেঞ্চও রয়েছে। কিন্তু সেই নদী এখন দূষণ আর আবর্জনার কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

নদীর কিনার দিয়ে স্তূপ হয়ে আছে হরেক রকমের বর্জ্য। ভাগাড়ের মতো পরিবেশ। কোথাও কোথাও শুকনো বর্জ্যগুলো একত্র করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পচা বর্জ্যের সঙ্গে কটু ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়।

৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান নৌ টার্মিনাল ঘাটের পাশে দেখা হলো মো. জহিরুল হকের সঙ্গে। তিনি পেশায় চিকিৎসক। নতুন চাষাঢ়া জামতলায় তাঁর বাড়ি। হন হন করে হেঁটে এলাকাটি পেরিয়ে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘এটা তো আর নদী নেই, শীতলক্ষ্যা এখন হয়েছে ভাগাড়।’ তিনি জানালেন আগে বিকেলে এখানে অনেকেই নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে আসতেন, বসতেন। কিন্তু নদীর পাড়ে ময়লা ফেলায় এমন অবস্থা হয়েছে যে আর বসার মতো পরিবেশ নেই। শহরেও যত্রতত্র ময়লা ছড়িয়ে আছে।

নদীর পাড় ধরে হেঁটে দেখা গেল বন্দর খেয়াঘাটের সামনে বিশাল এলাকাজুড়ে ছোটখাটো টিলার মতো স্তূপ হয়ে আছে আবর্জনা। গেরস্থালি বর্জ্য থেকে শুরু করে হেন কিছু নেই, যা সেখানে নেই। কোথাও কোথাও নদীর ভেতরে অনেকটা এলাকায় ছড়িয়ে গেছে সেসব বর্জ্য। একই রকম আবর্জনার স্তূপ দেখা গেল ৩ নম্বর ঘাটের উভয় ধারে। এখান থেকে ৫ নম্বর ঘাট পর্যন্ত নদীর ভেতরে আবর্জনা ও কচুরিপানা সরিয়ে এনে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে যেন নদীর ভেতর ছড়িয়ে না যায়। পাটবোঝাই বড় বড় নৌকা এসে ভিড়ছে চারার গোপ এলাকার কাছের ঘাটে। এখানে সড়কের ওপরে, নদীর ঢালে, ভেতরে আবর্জনায় ভরা। চারার গোপে বিশাল ফলের আড়ত। কলার কাঁদি, পচা ফল, ডাবের খোলে ফুটপাতগুলোও ভরে আছে।

নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত যেতে বিভিন্ন স্থানে শীতলক্ষ্যা নদীতে এভাবে বর্জ্য ফেলতে দেখা গেছে। তবে আদমজী ইপিজেড এবং এর আশপাশের এলাকায় দেখা গেছে, নদীতে এসে পড়ছে কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য। পাঠানতলা জেলেপাড়া এলাকার পুরোনো রেলসেতুর কাছে বিশাল এক নর্দমা দিয়ে খালে এসে পড়ছে কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য। সেখান থেকে যাচ্ছে নদীতে। পানি এখানে আলকাতরার মতো কালো হয়ে আছে। খালটির দুই কিনারের গাছপালা পর্যন্ত রাসায়নিকের বিষক্রিয়ায় মরে গেছে।

খালপাড়ের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সোহরাব উদ্দিন বললেন, পচা গন্ধে খালপাড়ের বাসিন্দাদের বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

নবীগঞ্জ ঘাট এবং রসুলবাগেও দেখা গেল নালা দিয়ে কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এসে সরাসরি নদীতে পড়ছে।

কাঁচপুরে ওয়াপদা কলোনির পাশের খালের দিকে তাকালে পানি যে বর্ণহীন, এই সত্যই ভুলে যেতে হয়। মনে হয় দোয়াতের কালির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কারখানাগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) বসিয়ে পানি শোধন করে নদীতে ফেলার কথা। কিন্তু যে পানি খাল-নালা দিয়ে অবিরাম নদীতে এসে পড়ছে, খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে তা শোধিত হয়ে আসছে না।

নদীদূষণের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ শহরের পরিবেশও নোংরা। সিদ্ধিরগঞ্জ, দ্বিগুবাবুর বাজার, ব্যাপারীপাড়ার পথের মোড়ে মোড়ে ময়লা-আবর্জনা। পথের পাশের নর্দমাগুলো আবর্জনায় ভরা। পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এ বি সিদ্দিক বললেন, নদীতীরের ডাইং কারখানাগুলোর রাসায়নিক বর্জ্য ও শহরের বর্জ্য এই দুই কারণে শীতলক্ষ্যা দূষিত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পলিথিন। বাপার পক্ষ থেকে বহুদিন থেকেই দাবি করা হচ্ছে কারখানাগুলোতে ইটিপি বসালেও তা প্রকৃতপক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনকে বলা হয়েছে নর্দমাগুলোর মুখ একসঙ্গে নিয়ে এসে ইটিপির মাধ্যমে পানি শোধন করে নদীতে ফেলা হোক, তা হয়নি। এ ছাড়া শহরের নর্দমাগুলোও পরিষ্কার করা হয় না। পথের পাশে আবর্জনা স্তূপ হয়ে থাকে। শহর দুর্গন্ধময় হয়ে আছে।

নদীদূষণ, বিশেষ করে শহরের ভেতরে পাঁচটি ঘাটে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর শাখার যুগ্ম পরিচালক মো. গুলজার আলী বলেন, নদীর দুই পাশে অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। মূলত এসব কারখানার বর্জ্যেই নদী দূষিত হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের বর্জ্যও নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে বর্জ্য না ফেলার ব্যাপারে বলা হয়েছে। তবে এগুলো দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মইনুল হক বলেন, কারখানার বর্জ্যেই মূলত শীতলক্ষ্যা দূষিত হচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য পানিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন, সেই পরিমাণে নেই। পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে। এ কারণে শীতলক্ষ্যা ক্রমেই মৃত নদীতে পরিণত হচ্ছে। একে বাঁচাতে হলে একা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্ন সংস্থা ও জনসাধারণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।