গুরুত্ব পাচ্ছে সড়কের দুর্গতি আর যানজট

রংপুরের যেকোনো বাসিন্দার কাছে শহরের সমস্যার কথা জানতে চাইলে প্রথমেই বলেন সড়কের কথা। শহরটি ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকেই সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এখনো তা চলছেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত এলাকার সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। অনেক সড়ক ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা।

উন্নয়নের দীর্ঘসূত্রতায় সড়কের এই দুর্গতি এবং নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহনের দুর্বিষহ জট নগরবাসীর ভোগান্তি ও অসন্তুষ্টির প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও
ভোটারদের কাছে সড়ক ও যানজট বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে মেয়র বলেছেন, এ জন্য তিনি দায়ী নন। আসলে তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। প্রশাসন সহায়তা করে না, তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় নেই।

প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে শাপলা মোড় থেকে স্টেশন রোডের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, মোড়ের সামনেই আড়াআড়ি গভীর গর্ত করে পাইপ বসানো হচ্ছে। সড়কটি চওড়া করা হচ্ছে। পুরো রাস্তা খুঁড়ে পুরোনো ঢালাই তুলে রাখা। লোকজন এর ভেতর দিয়ে কোনো রকমে চলছে। এক পাশ দিয়ে একটি-দুটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক যাচ্ছে। সড়কের উভয় পাশে দোকানের সারি। বিক্রেতারা বেজার মুখে বসে আছেন। স্টিলের সামগ্রী বিক্রেতা মিম স্টিল নামের দোকানের মালিক পারভেজ হোসেন বললেন, চলাচলের অসুবিধার জন্য লোকজন এখানে আসতেই চায় না, পুরো এলাকার ব্যবসা খুবই খারাপ। এর চেয়ে আগের সরু সড়কটিই ভালো ছিল।

আরও খারাপ অবস্থা দেখা গেল জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে দেওয়ান বাড়ি সড়কে। দেওয়ান বাড়ি অনেকটা পুরান ঢাকার চকবাজারের মতো। শহরের প্রধান পাইকারি ও খুচরা বিক্রির হাজারো দোকান এই বিশাল এলাকায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বহু মানুষের সমাগমে গমগম করে পরিবেশ। ঠিক দোকানগুলোর সামনে দিয়েই গভীর নর্দমা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। দোকানমালিকেরা যাতায়াতের জন্য লোহার পাত বা বাঁশের মাচান তৈরি করে সেতুর মতো বিছিয়ে রেখেছেন সেই নর্দমার ওপর। দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে অনেকেই ভাষার সৌজন্য-শালীনতার সীমাও হারিয়ে ফেললেন।

শহরে প্রবেশের একটি প্রধান সড়ক কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে গেছে শাপলা চত্বর পর্যন্ত। এর সংস্কার হচ্ছে এক বছর ধরে। এর আগেও একবার হয়েছে। পুরো সড়ক খানাখন্দে ভরা। কোথাও কোথাও বালু-সুরকির স্তূপ। কোথাও রোলার দিয়ে ইট-সুরকি সমান করা হচ্ছে। তার পাশ দিয়েই রিকশা ও ইজিবাইকগুলো ধুঁকে ধুঁকে এগোচ্ছে। ফুটপাত বলে কিছু নেই। বৃষ্টি হলে হাঁটুপানি জমে যায় বলে জানালেন সড়কের পাশের অনির্বাণ কনফেকশনারির মালিক আবদুল হামিদ। এই মহল্লার নাম গণেশপুর। এবার বর্ষায় দুর্ভোগ ছিল মাত্রাছাড়া।

শহরের অন্যতম প্রধান এই তিন সড়ক ছাড়াও কলেজ রোড, তাজহাট রোড, বাইপাস রোড, মাহিগঞ্জ রোড, কামালকাছনা রোডসহ অধিকাংশ সড়কেই দেখা গেছে খানাখন্দে ভরা। পাশে নর্দমা বা ফুটপাত নেই।

রংপুর সিটি করপোরেশন হওয়ার পর সড়ক উন্নয়নের রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। পুরোনো ১৬ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করে চার লেন করা হয়েছিল। শুরু হয়েছিল মডার্ন মোড় থেকে। শহরের ভেতরের চার লেনের জন্য প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা জাহাজ কোম্পানি মোড়ের শত শত দোকানপাট, অফিসের পুরোনো ভবন ভাঙা হয়েছিল। বিদ্যুতের খুঁটি সরানো হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমায় অনেক দিন কাজ আটকে ছিল। টানা প্রায় বছর চারেক চলেছে এই ভাঙচুরের কাজ। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া ১২৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এই কাজ ২০১৫ সালে যখন শেষ হলো, তারপর দেখা যাচ্ছে চার লেন কার্যত সাবেক আমলের দুই লেনেই পরিণত হয়েছে হকার, অটো, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ অসংখ্য যানবাহনের দখলের কারণে।

এই ছোট্ট শহরে এখন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। আছে হাজার হাজার প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। যাত্রীর অপেক্ষায় এগুলো ব্যস্ত এলাকার সড়কের দুই পাশে ও মোড়ে অপেক্ষা করে। ফলে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। মডার্ন মোড়, টার্মিনাল মোড়, কারমাইকেল কলেজের প্রধান ফটক, মেডিকেল মোড়, কামালকাছানা মোড়, পায়রা চত্বরসহ সব কটি মোড়ে ইজিবাইক আর রিকশার কারণে মোড় থেকে মূল সড়কে ওঠাই কঠিন। অধিকাংশ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ নেই।

রংপুরের বিখ্যাত টাউন হলের সামনে থেকে জাহাজ কোম্পানি মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। এখানেই রাজা রামমোহন রায় মার্কেটসহ শহরের অভিজাত বিপণিবিতানগুলো। এখানে জটলাও সব থেকে বেশি। চার লেনের সড়ক রাজা রামমোহন রায় মার্কেটের সামনে এসে কেন যেন সরু হয়ে গেছে। এই দুই কিলোমিটার যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে।

এ ছাড়া সড়কের উভয় পাশের এক লেন বিভিন্ন যানবাহন দখল করে রাখায় তীব্র যানজট হচ্ছে শহরের দক্ষিণ অংশের ধাপ এলাকায়। এখানে অসংখ্য রোগনির্ণয় কেন্দ্র, ক্লিনিক, চিকিৎসকদের চেম্বার, ওষুধের দোকান রয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন, আনোয়ার হোসেনসহ বহু মানুষ অভিযোগ করেছেন, সড়কের নৈরাজ্য তাঁদের জীবনযাত্রা অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ইজিবাইকের কারণেই শহরে যানজট হচ্ছে। এসব ইজিবাইক কে নিয়ন্ত্রণ করবে! সিটি করপোরেশনকেই মূল দায়িত্ব নিতে হবে, পুলিশ প্রশাসন প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে।

জানতে চাইলে মেয়র সরফুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমার অবস্থা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদারের মতো। আমার কোনো পুলিশ নেই, ম্যাজিস্ট্রেট নেই। সিটি করপোরেশন থেকে ৪ হাজার ৮০০ ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। দুই বছর লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ। কিন্তু চলছে ৪০ হাজারের বেশি। উচ্ছেদের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে দেওয়া হয় না। অথচ লোকে সবকিছুর জন্য মেয়রকে দায়ী করে, মেয়রের কাছে জবাব চায়। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এইচ এম এরশাদ সদরের সাংসদ, তিনি এসব সমস্যা নিয়ে কোনো দিন কিছু বলেননি। এখানে একজন প্রতিমন্ত্রী আছেন, তিনিও তো কিছু করেননি।’

সড়ক সম্পর্কে মেয়র বলেন, চার লেনের কাজ করেছে সড়ক ও জনপথ। ভবনমালিকদের মামলার কারণে অনেক দিন কাজ আটকে যায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করলে তারপর কাজ শুরু হয়। ফলে সড়ক তৈরিতে লম্বা সময় লেগেছে। এখন অধিকাংশ প্রধান সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। টার্মিনাল থেকে শাপলা চত্বর ও স্টেশন রোডের কাজ চলছে। ছোট সড়কগুলোর কাজেরও দরপত্র হয়েছে। ইট পাওয়া যাচ্ছে না বলে ঠিকাদারেরা দ্রুত কাজ করতে পারছেন না। শিগগিরই সব সড়কের মেরামত সম্পন্ন হবে।