বদলে যাওয়ার গল্প

বরগুনার আমতলী উপজেলার বেতমোর গ্রামে কেঁচো সার তৈরির খামারে কাজ করছেন কয়েকজন নারী। সম্প্রতি শাহিনূর বেগমের খামার থেকে তোলা ছবি। ছবি: প্রথম আলো
বরগুনার আমতলী উপজেলার বেতমোর গ্রামে কেঁচো সার তৈরির খামারে কাজ করছেন কয়েকজন নারী। সম্প্রতি শাহিনূর বেগমের খামার থেকে তোলা ছবি। ছবি: প্রথম আলো

সিডরে ঘরবাড়ি হারান গোপাল বালা (৪০)। উপার্জনের পথটাও এলোমেলো। গ্রাম থেকে সপরিবার চলে আসেন ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা শহরে। ভাড়া করা ঘরে বসবাসের বন্দোবস্ত হলো। কিন্তু সংসার চলবে কীভাবে? শুরু করলেন দরজির কাজ। এতে গোপালের দৈনিক আয় এক থেকে দেড় শ টাকা। বুদ্ধি খাটিয়ে স্ত্রী সুবর্ণা বালা ছোট্ট মুদিদোকান দেন। দিনে দিনে সেই দোকানের পরিসর বেড়েছে। সংসারে এসেছে সচ্ছলতা।

শাহিনূর বেগমও এখন স্বাবলম্বী। বরগুনার আমতলীর এই মেয়ে কেঁচো সার তৈরি ও সবজির আবাদ করেন। গত পাঁচ বছরে তিনি বসতভিটা ও মাঠে ৪৫ শতক জমি কিনেছেন। তুলেছেন দোতলা টিনের ঘর। শাহিনূরের ভাষায়, ‘সিডরের আগে এই অঞ্চলের নারীরা এত অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত ছিল না। গৃহস্থালিতে সময় দিত। এখন নারীরা সংসার-সমাজে অবদান রাখছে। আর্থিক সক্ষমতা আসায় তাদের ক্ষমতাও বেড়েছে।’

১০ বছর আগে (২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাত) প্রলয়ংকরী সিডর দক্ষিণ উপকূলে অর্থনীতির ধস নামিয়েছিল। এখন উপকূল-দূরবর্তী এলাকায় আর্থসামাজিক চিত্র বদলেছে। মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর টুকরো টুকরো গল্পের পেছনে নারীর অবদানও চোখে পড়ার মতো। শুধু অর্থনীতি নয়, দক্ষিণাঞ্চলে সামাজিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর ছাপ ফেলেছে সিডর। মানুষ দুর্যোগে টিকে থাকতে নিজস্ব তাগিদে নিত্যনতুন কৌশল শিখে নিয়েছে। বেড়েছে দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা। মানুষ নিজেরা যেমন উদ্যোগী হয়েছে, তেমনি সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টাও ছিল। সার্বিকভাবে অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে।

দুর্যোগ-সহনীয় বাড়িঘর

যুগ যুগ ধরে দক্ষিণাঞ্চলবাসী কাঠের দোতলা ঘরে টিনের ছাউনি দিয়ে বসবাসে অভ্যস্ত। সিডরের বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির প্রধান কারণ ছিল এসব নাজুক ঘর। ওই ঘূর্ণিঝড়ে ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০০টি ঘরের ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৬৮। এই হিসাব খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের। ২০০৭ সালের ৭ ডিসেম্বর সিডরে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়।

দক্ষিণ উপকূলে ঘরে টিনের ছাউনি এখনো প্রচলিত। তবে বেশির ভাগ মানুষ আর কাঠ ব্যবহার করে না। সীমিত আর্থিক সক্ষমতার মধ্যেও ইটের দেয়াল ও মেঝে বানাচ্ছে। সিডর-প্রলয়ই গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তায় এই বদল এনেছে।

১৯৯১ সালের আদমশুমারি বলছে, বরগুনায় মোট ঘরের ৬৮ দশমিক ৯২ ভাগই ছিল ছন, বাঁশ পাটকাঠি ও পলিথিনের। ৩০ দশমিক ৫৯ ভাগ টিন ও টালির। শূন্য দশমিক ৪১ ভাগ ঘরে ছিল ছাদ। সিডরের পর এই অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এখন সবাই দুর্যোগকে প্রাধান্য দিয়ে টেকসই ঘর বানাচ্ছে।

তালতলীর উপজেলার প্রত্যন্ত জয়ালভাঙা গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী দুলাল মিয়া সিডরে ঘর হারিয়েছেন। তিনি খুপরি তুলে বাস করছিলেন। এখন ইটের দেয়ালের ঘরে থাকেন। বললেন, ‘প্রায়ই ঝড় হয়, ঘরদোর ক্ষতি হয়। তাই কষ্ট করে হলেও পাকা ঘর তুলেছি। ঝড় আর ক্ষতি করতে পারবে না।’

নিম্নআয়ের মানুষও এখন কাঁচা ঘর তুলছে না। সহজে ভাঙে না, ঘরের নিচে এমন আলাদা ভিত তৈরি করে কিছু পাকা খুঁটি দিচ্ছেন। ছাউনি টেকসই করতে কাঠের ফ্রেমের পরিবর্তে লোহার পাত বা রড ব্যবহার করছেন। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের বরিশাল বিভাগের ব্যবস্থাপক শাহরুখ সোহেল বলেন, গৃহনির্মাণে মানুষের এই উদ্যোগ দুর্যোগ সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

কৃষিতে বৈচিত্র্য

বরিশালের ছয় জেলায় ৭ লাখ ৪১ হাজার ৩১০ হেক্টর কৃষিজমির অধিকাংশই ছিল এক ফসলি। আমন মৌসুমনির্ভর। সিডরে ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৯৪৪ একরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপুল শস্যহানির পর পতিত জমিকে বহু ফসলি করার প্রচেষ্টা বাড়ে। গত কয়েক বছরে এখানে আমন ধানের পাশাপাশি আউশ ফলাচ্ছেন কৃষক। এখন বিভাগে গড়ে প্রতিবছর ২৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। ১৬ লাখ মেট্রিক টনের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি ৭ লাখ ৪০ হাজার টন অন্যত্র যাচ্ছে।

বরিশাল কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগে রবি মৌসুমে এখানে ৮০-৮৫ ভাগ জমি পতিত থাকত। সিডরের পর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কম জীবনকালের ফসল সূর্যমুখী, বারি ৬ ও ১ জাতের মুগ, বাঙ্গি, তরমুজ চাষ হচ্ছে প্রচুর। ধানের ক্ষেত্রে ব্রি ৪৭ ও ৫২ এবং বিনা-১১ জাতের আবাদ বেড়েছে। সারা বছর বেড পদ্ধতিতে সবজির চাষ হচ্ছে। এতে ভেষজ কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। কেঁচো সার, কম্পোস্ট সার ও খামারজাত সারের মতো জৈব ও জীবাণু সার ব্যবহৃত হচ্ছে।

যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন

খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিডরে বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৭১৪ কিলোমিটার সড়ক পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আংশিক ক্ষতি হয় ৫ হাজার ৭৬৭ কিলোমিটার সড়কের। ১ হাজার ৬৮৭টি সেতু ও কালভার্ট ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই ১০ বছরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যোগাযোগ ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। রাস্তাঘাট মেরামত ও পাকা সড়ক নির্মাণ করায় প্রত্যন্ত এলাকার সঙ্গে জেলা ও উপজেলা সদরের যোগাযোগ মসৃণ হয়েছে। এটা এলাকায় উৎপাদন বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।

সিডরের পর পিকেএসএফের সহযোগিতায় আঞ্চলিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম১৪৭টি সড়ক মেরামত ও ৫১টি নতুন সড়ক নির্মাণ করে। এতে ব্যয় হয় ৪ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৫০ টাকা। এ ছাড়া সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতায় ৫৬টি সড়ক মেরামত ও ২৮টি নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয় ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫১ হাজার ১০০ টাকা ব্যয়ে। এসব প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজনের কর্মসংস্থান হয়। এতে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অগ্রগতি

সিডরে উপকূলের ৪ হাজার ২০১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ এবং ১২ হাজার ৬৭৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে বরগুনারই ১ হাজার ২৩৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১ কোটির মতো শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ব্যাহত হয়। তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ সফল হয়েছে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সিডরের ভয়াবহতায় আতঙ্কিত শিশুদের মানসিক অবস্থা পরিবর্তনে বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শাখা চালুর কাজে সহায়তা দেয়। বরগুনা সদরের ১৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নতুন ভবন নির্মাণ করে দেয়।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, সিডরের পর তাঁরা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর হার অনেক বেড়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে, বর্তমানে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৩ হাজার ৭৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমান সরকারের মেয়াদে ৯৭০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়। ৬৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ২২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ রয়েছে। ৫৪টির দরপত্র হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সক্রিয় করার প্রশিক্ষণে জোর দিচ্ছে অধিদপ্তর।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল ওয়াজেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলো চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। একটি কেন্দ্রে সাধারণত আট শ থেকে এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। সেই হিসাবে উপকূলের ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের জন্য কমপক্ষে ২২ হাজার ৫০০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর প্রতিটিতে ১ হাজার মানুষ উঠলেও বিপদে থাকবে প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।

দুর্যোগ সচেতনতা বেড়েছে

আগে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেলেও মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনাগ্রহ ছিল। সিডরের সময় বিশেষত এ কারণেই প্রাণহানি হয় অনেক বেশি (৩ হাজার ৩৪৭ জন)। নিখোঁজ হয় ৮৭১ জন।

মানুষের ভিটা না ছাড়ার ওই প্রবণতা কমেছে। সিডরের এক বছর পর আঘাত হানা ‘আইলা’ ধ্বংসযজ্ঞে কম যায়নি, কিন্তু প্রাণহানি খুব কম ছিল। গত ১০ বছরে আরও অন্তত সাতটি ঘূর্ণিঝড় এলেও প্রাণহানি হয়েছে খুবই কম। অর্থাৎ, উপকূলবাসীর মধ্যে দুর্যোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ কাজে দিয়েছে।

আঞ্চলিক সংস্থা সংগ্রামের দুর্যোগ সচেতনতা কর্মসূচির প্রধান মাসউদ সিকদার বলেন, মানবিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি দুর্যোগ সচেতনতায় অনেক কাজ হয়েছে। দুর্যোগের সংকেত এলে এখন আর মানুষ ভিটেমাটিতে আঁকড়ে থাকে না।

পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিশু সুরক্ষা, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি সূচকেও গত ১০ বছরে উপকূলে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।