বদলে যাওয়ার গল্প

কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। রয়েছে প্রশিক্ষকও। সম্প্রতি তোলা ছবি l সৌরভ দাশ
কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। রয়েছে প্রশিক্ষকও। সম্প্রতি তোলা ছবি l সৌরভ দাশ

প্রত্যন্ত গ্রামের একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেমন? কল্পনা করে নিন। আপনার মনে সাদামাটা যে বিদ্যালয়ের ছবি তৈরি হয়েছে, সেটি ছয় বছর আগের। মাত্র ছয় বছরেই কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে গেছে।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জিরি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড। স্থানীয় ফকিরা মসজিদ বাজার থেকে ৫০০ গজ ভেতরে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই বেশ বড় একটি ফটক চোখে পড়বে। চারপাশে পাকা সীমানাদেয়াল। ফটক দিয়ে ঢুকতেই সবুজ মাঠ। তিন পাশে ঝকঝকে তিনটি ভবন। এর মধ্যে দুটি ভবন দোতলা, আরেকটি ভবনে চলছে দ্বিতীয় তলা সম্প্রসারণের কাজ। মাঠের একপাশে দুটি করে দোলনা, স্লিপার। ৬৯ শতক জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যালয়টির নাম পূর্ব জিরি আমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
ছয় বছর আগেও এখানে ছিল জীর্ণ দুটি একতলা ভবন। তখন বিদ্যালয়ের আয়তন ছিল ৩৩ শতক। কক্ষ-সংকটে দুই পালায় চলত শ্রেণি কার্যক্রম। এখন এক পালায় চলছে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে শুরু করে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান। বিদ্যালয় ছুটি শেষে অমনোযোগী ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে তিন ঘণ্টা বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা। সন্ধ্যায় পাঠদানের সুবিধার্থে রয়েছে বিকল্প বিদ্যুৎব্যবস্থা (আইপিএস)। পুরো পটিয়া উপজেলায় শুধু এ বিদ্যালয়েই রয়েছে দুপুরের খাবারের (মিড ডে মিল) ব্যবস্থা। এ ছাড়া দুই মাস পর পর মা সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণকক্ষ, পাঠাগার, মাল্টিমিডিয়া কক্ষ, মিলনায়তন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আরও একটি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি ভবনের সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। ১৩ জন সরকারি শিক্ষকের পাশাপাশি ব্যক্তি অনুদানে আরও চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে একজন আয়ার। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে চিকিৎসা কার্ড। শিক্ষার্থীদের সুপেয় পানির জন্য খোঁড়া হয়েছে গভীর নলকূপ। ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে দুটি করে আলাদা শৌচাগার। খাবারের আগে ও শৌচাগার থেকে বের হয়ে সব শিক্ষার্থী যাতে সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারে এ জন্য শৌচাগারের সামনে রয়েছে দুটি বেসিন।
২০১৪ সালে বিদ্যালয়টি চট্টগ্রাম বিভাগের সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দেশের সেরা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির স্বীকৃতি পায় এই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি। বিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে দেওয়ার পেছনে রয়েছে দুজন মানুষের অবদান। একজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মহিম উদ্দিন, অন্যজন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. লোকমান হাকিম। মহিম উদ্দিন ২০০৮ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিদ্যালয়ের দৈন্যদশা দেখে নিজ উদ্যোগে এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী লোকমান হাকিমকে বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন।
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সভাপতি নিঃস্বার্থভাবে বিদ্যালয়টির পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিদ্যালয়টিকে আমরা দেশের সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। “আমাদের স্কুল, আনন্দের এক রঙিন ফুল” স্লোগানে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।’
বিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় অন্য গ্রামের অভিভাবকেরাও এই বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন। মুক্তা আক্তার নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘আগে আমার ছেলেকে কাছের একটা স্কুলে দিয়েছিলাম। পরে এই স্কুলের কথা শুনি। আমার বাসা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হলেও এখানে শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা দেখে ছেলেকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেছি।’
শুরুর কথা: পূর্ব জিরি আমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির বয়স এখন ৯১ বছর। ১৯২৫ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির দান করা জমির ওপর এ বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল চার কক্ষের একটি একতলা ভবন। এই ভবনও তৈরি হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে স্থানীয় দুজন ব্যক্তির সহায়তায় ওই ভবনে আরও তিনটি কক্ষ সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০২ সালে সরকারি উদ্যোগে পাশে আরেকটি দুই কক্ষের ভবন তৈরি হয়। এই সাতটি কক্ষের মধ্যে পাঁচটিতে গাদাগাদি করে বসতে হতো শিক্ষার্থীদের। পুরোনো কক্ষগুলোর জানালা-দরজা ছিল ভাঙা, ছাদ চুঁইয়ে পড়ত পানি। ছিল না পর্যাপ্ত টেবিল ও বেঞ্চ। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর মহিম উদ্দিন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সবাইকে বিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান। ব্যবস্থাপনা কমিটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে এলে জরাজীর্ণ বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণি ও শিক্ষক-সংকটের কথা তুলে ধরে ভবনটি মেরামতে সহায়তা চান তিনি।

মো. লোকমান হাকিম, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, মো. মহিম উদ্দিন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
মো. লোকমান হাকিম, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, মো. মহিম উদ্দিন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক

ব্যবসায়ী লোকমান হাকিম তখন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হয়েছেন। প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে শ্রেণিকক্ষগুলো ঘুরে দেখেন। তিনি নিজেও ছিলেন এই বিদ্যালয়ের ছাত্র। নিজের বিদ্যালয়ের দৈন্যদশা দেখে সিদ্ধান্ত নেন যে মেরামত নয়, নতুন করে ভবন তৈরি করে দেবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেন বিদ্যালয়ের জায়গা বাড়াতে হবে। পুরোনো বিদ্যালয়ের সঙ্গে লাগোয়া আরও ৩৬ শতক জায়গা কেনেন। মাটি ভরাট করে তৈরি করে দেন বড় মাঠ। ২০১১ সালে তৈরি হয় নতুন একটি দোতলা ভবন। এর উল্টো দিকের সাত কক্ষের পুরোনো ভবনটি ভেঙে ২০১৪ সালে আরও একটি দোতলা ভবন তৈরি করেন। সরকারি অর্থে করা একতলা ভবনের ওপর এখন চলছে দোতলা সম্প্রসারণের কাজ। ছয় বছর আগেও যেখানে বিদ্যালয়টিতে সব মিলিয়ে কক্ষ ছিল সাতটি, সেখানে এখন কক্ষের সংখ্যা ২৩টি। খুব শিগগিরই আরও পাঁচটি কক্ষের নির্মাণকাজ শেষ হবে।
লোকমান হাকিমের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য হাসপাতালে শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। বিদ্যালয়ের আমূল সংস্কারে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ২০১১ সালের আগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৬৯। আর এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৫১। ভালো হচ্ছে পরীক্ষার ফলাফলও। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে শতভাগ পাস করছে। বেড়েছে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যাও। ২০১৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১৫ জন, গত বছর পেয়েছে ২৩ জন। বিদ্যালয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় ২০১৫ সাল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি ও চলতি বছর থেকে সপ্তম শ্রেণির কার্যক্রম চালু হয়েছে।
দুপুরের খাবার আর বিশেষ পাঠদান: পটিয়ায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৮৫টি। এর মধ্যে ২০১৩ সালে তিনটিতে সামাজিক উদ্যোগে মিড ডে মিল চালু করা হয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় শেষ পর্যন্ত দুটি বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন শুধু পূর্ব জিরি আমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা চালু আছে। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার হিসেবে কলা, রুটি, সমুচা বা শিঙাড়া দেওয়া হয়।
পটিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোতাহের বিল্লাহ বলেন, ‘লোকমান হাকিমের উদ্যোগে বিদ্যালয়টিতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা চালু আছে। এটিকে আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করছি।’

পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্যের ওপর নানা বিষয়ের বই পড়ার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা l ছবি: প্রথম আলো
পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্যের ওপর নানা বিষয়ের বই পড়ার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা l ছবি: প্রথম আলো

বিশেষ যত্ন প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিদ্যালয়ে বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর বিশেষ পাঠদানের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আরও ১০ জন শিক্ষক। চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এই বিশেষ পাঠদান নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
শামিমা ইয়াসমিন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘বিদ্যালয়ের পাশেই আমার বাড়ি। শিক্ষকেরা তো প্রায়ই বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ নেন।’
পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চা ও খেলাধুলায় ভালো করছে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফুটবলের জন্য রয়েছেন আলাদা কোচ। চলতি বছর এই ছেলেদের দল উপজেলা বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মেয়েদের দল বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল খেলেছে। সক্রিয় রয়েছে স্টুডেন্ট কাউন্সিলও (ছাত্র পরিষদ)।
বিদ্যালয় পরিচালনায় যুক্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. লোকমান হাকিম বলেন, ‘নামের প্রতি মোহ থাকলে নিজের নামেই একটা বিদ্যালয় করতে পারতাম। আমি চাই আমার এলাকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে।’
এ বিষয়ে পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিজের অর্থে একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেহারা বদলে দিয়েছেন লোকমান হাকিম। এটি খুবই প্রশংসনীয়। এভাবে যাঁর যাঁর এলাকায় সামর্থ্যবান মানুষেরা এগিয়ে এলে প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তন হবে, শিক্ষার মানও বাড়বে।