হাসপাতালই শিশুটির বাড়ি!

বাবার চিকিৎসার কারণে হাসপাতালেই বড় হচ্ছে শিশু রিফান। ছবি: প্রথম আলো
বাবার চিকিৎসার কারণে হাসপাতালেই বড় হচ্ছে শিশু রিফান। ছবি: প্রথম আলো

জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ করতে গিয়ে যখন বাবার দুই পা ভেঙে যায়, তখন রিফানের বয়স ছিল ৭ দিন। সেই থেকে আহত বাবার সঙ্গে হাসপাতালেই থাকছে রিফান। মাঝখানে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তিন মাস বাড়িতে ছিলেন বাবা। ওই কটা দিনই বাড়িতে ছিল রিফান। বাবা ফের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় আবার হাসপাতালে এসেছে শিশুটি।

মো. রিফান। এখন ১১ মাসে পড়েছে শিশুটি। এর আট মাসই বাবা-মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে কেটেছে তার। এভাবেই বড় হচ্ছে সে। তার বাবার নাম ফারুক হোসেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি স্টিল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড নামের একটি জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ করতে গিয়ে গত ২ জানুয়ারি আহত হন তিনি। রাতে লোহার খণ্ডের সঙ্গে হুইন্স মেশিনের হুক লাগিয়ে ফারুক ফিরছিলেন উপকূলের দিকে। হঠাৎ হুক খুলে গিয়ে তাঁর দুই পায়ে আঘাত করে। পরে অন্য শ্রমিকেরা তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলার ভাটিয়ারির বাংলাদেশ শিপব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিএ) হাসপাতালে ভর্তি করেন। খবর শুনেই রিফানকে নিয়ে ফারুকের স্ত্রী রোজিনা খাতুন ছুটে আসেন হাসপাতালে।

সেই থেকে শুরু। মো. ফারুক হোসেন আট মাস ধরে চিকিৎসাধীন। ফারুকের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার মালিপাড়া গ্রামে। স্ত্রীকে নিয়ে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তিনি। দুর্ঘটনার পর থেকে ফারুককে দেখাশোনার জন্য স্ত্রী রোজিনা ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে রয়েছেন। ভাড়া বাসাও এখন ছেড়ে দিয়েছেন। হাসপাতালই এখন বাড়ি।

বিএসবিএ হাসপাতালের তিনতলার ১ নম্বর বেডে গত বুধবার বিকেলে ফারুকের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁর পায়ের কাছে শিশু রিফান গড়াগড়ি করছিল। অবুঝ শিশুটি জানেই না, সে হাসপাতালে, না বাড়িতে!

হাসপাতালে শত ব্যস্ততায় রিফানের ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারছেন না মা রোজিনা। তিনি বলেন, একটু পরপরই ওষুধ কিনতে বা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে যেতে হয়। খাবারের বন্দোবস্তও করতে হয়। এর ফাঁকে ফাঁকে সামলান ছেলেকে। যখনই ছেলে কেঁদে ওঠে, তখনই বুঝতে পারেন তার খিদে পেয়েছে।

ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি বিএসবিএর দ্বিতীয় তলার ৬ নম্বর বেডে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসায় ডান পা সুস্থ হয়েছে। কিন্তু বাঁ পা এখনো ভাঙা এবং ঘা শুকায়নি।

ফারুকের দাবি, গত ১৭ জুলাই পর্যন্ত মালিকপক্ষ তাঁর চিকিৎসা খরচ ও বেতন দিয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল ছাড়ার পর বেতন বন্ধ রয়েছে। ফারুকের স্ত্রী রোজিনা খাতুন বলেন, বাড়িতে থাকা অবস্থায় মাসের বেতনের জন্য কারখানার ব্যবস্থাপককে ফোন দিলেও কাজ হয়নি। টাকার অভাবে বাঁ পায়ের চিকিৎসা করতে না পারায় ক্ষত বাড়তে থাকে। এখন আবারও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে ফারুককে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিএসবিএ হাসপাতালে ছিলেন রিফানের বাবা। এরপর সপরিবারে জামালপুরে নিজের বাড়ি চলে যান তিনি। গত মাসের ৮ তারিখ থেকে আবার একই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ফারুক। গত ৩১ অক্টোবর ফারুকের বাঁ পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো. আবদুল হাই খান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম আইন অনুসারে কর্মস্থলে কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় আহত হলে চিকিৎসার ব্যয় মালিকপক্ষ বহন করবে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার পর প্রথম দুই মাস পূর্ণ বেতন পাবেন। পরবর্তী দুই মাস বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ পাবেন, পরের ছয় মাস অর্ধেক বেতন পাবেন। এরপর আইন অনুযায়ী যা প্রাপ্য, তা পাবেন।

ফারুকের চিকিৎসক মঈন উদ্দীন মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ফারুক পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও কয়েক মাস লাগবে। মালিকপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিক। তাঁর যথাযথ চিকিৎসা করা হচ্ছে।

কারখানার মালিক নাঈম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত ফারুকের চিকিৎসা ব্যয় বাবদ পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন। বেতনও দিয়েছেন। এখন হাসপাতালে যাঁরা আছেন, তাঁরা খোরাকির টাকা (খাওয়ার খরচ) পাবেন। গত বুধবারই ফারুককে অর্ধেক মাসের বেতন বাবদ কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।