কোনো না কোনো ঝুঁকিতে ৯৭ শতাংশ মানুষ

বাংলাদেশের জনসংখ্যা
বাংলাদেশের জনসংখ্যা

বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ঝুঁকির মধ্যে আছে। নারী হওয়ার কারণে কেউ পিছিয়ে আছেন। যথাযথ শিক্ষার অভাবে অনেকে শোভন চাকরি পাচ্ছেন না। কেউ হয়তো চর ও হাওর অঞ্চলে বাস করেন। আয় কম হওয়ায় মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারছেন না।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশের রূপান্তরমুখী অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অন্বেষণে: কাদেরকে পেছনে রাখা যাবে না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। আজ বুধবার এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত নাগরিক সম্মেলনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) অন্যতম উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সিপিডি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

বিপন্ন মানুষকে চিহ্নিত করতে ১৩টি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছে সিপিডি। এগুলো হলো জীবনচক্র, সামাজিক অবস্থান, প্রতিবন্ধিতা, শিক্ষা ও দক্ষতা, লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান, স্বাস্থ্য, আয়, পেশা, ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, লিঙ্গভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা, অভিঘাতজনিত বিষণ্নতা। এই বৈশিষ্ট্য দিয়েই দেশের কোন ধরনের মানুষ কতটা বিপন্ন তা চিহ্নিত করা হয়েছে।

সিপিডি বলছে, দেশের ৯৭ শতাংশের মানুষের মধ্যে বিপন্ন মানুষের দশটি বৈশিষ্ট্যের অন্তত একটি আছে। ২৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে বিপন্নতার মোট তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। ২ দশমিক ৯৮ শতাংশের মানুষের মধ্যে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাবই বড় ঝুঁকিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

 এ বিষয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, আয় ও সম্পদের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিবিএসের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে সবচেয়ে ওপরের ও সবচেয়ে নিচের দিকের ৫ শতাংশ মানুষের আয় বৈষম্য ছিল ৩২ গুণ। ২০১৬ সালে এই বৈষম্য বেড়ে ১২১ গুণ হয়েছে। ২০১০ সালে ওই দুই শ্রেণির মানুষের সম্পদের পার্থক্য ছিল ১ হাজার ১৭৬ গুণ। অনুমান করা হচ্ছে ২০১৬ সালে তা আড়াই হাজার গুণের বেশি হয়েছে। তাই মানুষের বিষণ্নতা রোধে সরকার যেসব কার্যক্রম নিচ্ছে, এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটি এখন শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়; রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কারা বিপন্ন জনগোষ্ঠী

লিঙ্গবৈষম্যের কারণে নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। হেপাটাইটিস বি এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর খর্বাকৃতি প্রতিরোধে জাতীয় গড় থেকে নারী শিশুর অবস্থা ভালো। এসডিজির পাঁচটি সূচকে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য ব্যাপক। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রতি ঘণ্টায় গড় আয়ে নারীরা পিছিয়ে আছেন।

 শহরের তুলনায় গ্রামে বৈষম্য বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অপুষ্টি রোধ ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু। এ-সংক্রান্ত এসডিজির অন্তত ১৫টি সূচকে বরিশাল বিভাগ পিছিয়ে আছে। সিলেট ও রংপুরে যথাক্রমে ১৪ ও ১৩টি সূচকে পিছিয়ে।

 জাতীয়, শহর কিংবা গ্রামের প্রতি পরিবারের গড় সম্পদের চেয়ে কম সম্পদ রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার পরিবারে। এই অঞ্চলটির শিক্ষা হারও জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় পার্থক্য কম। তবে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় বৈষম্য বেড়েছে।

এ দেশে ভোগবৈষম্যের চেয়ে আয়বৈষম্য বেশি। আয়বৈষম্যের চেয়ে সম্পদবৈষম্য আরও বেশি। শহরের মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদবৈষম্য—দুটোই বেশি। গ্রামে ভোগবৈষম্য বাড়লেও শহরে কমেছে। কম আয়ই মানুষকে বেশি বিপন্ন বা ঝুঁকিপূর্ণ করে।

অল্প শিক্ষিতদের শোভন কাজের সুযোগ কম। তারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। শিক্ষার হার কম থাকায় প্রতিবন্ধীরা সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। পরিবারের প্রধান প্রতিবন্ধী হলে অন্য পরিবারের চেয়ে ওই পরিবারের সম্পদ কম হয়।

অগ্রাধিকার

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঝুঁকি বা বিপন্নতার সঙ্গে দারিদ্র্যের যোগসূত্র আছে। শিশু, তরুণ-তরুণী, উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা, প্রতিবন্ধী, নারী, চর ও হাওরের মানুষ, আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায় এবং তৃতীয় লিঙ্গ ও হিজড়া সম্প্রদায়ের দিকে বেশি নজর দেওয়া দরকার। তাঁদের উন্নয়নে ছয়টি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করে সিপিডি। প্রথম, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ পায় না। দ্বিতীয়, আদিবাসী, চর ও হাওরবাসীর যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসুবিধা, বিদ্যুতের মতো পর্যাপ্ত মৌলিক অবকাঠামো নেই। তৃতীয়, বয়স, জেন্ডার, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়সহ নানা কারণে ভূমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। চতুর্থ, দুর্বিপাকজনিত অভিঘাত বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে আরও সমস্যায় ফেলে। যেমন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চর ও হাওরে বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। পঞ্চম, নিরাপত্তাহীনতা কিছু জনগোষ্ঠীকে ঝুঁকিকে ফেলে। ষষ্ঠ, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব আছে।

সুপারিশ

ঝুঁকি কমাতে ১৩টি নীতি সুপারিশ করেছে সিপিডি। যেমন নারী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি জীবনচক্রভিত্তিক নীতি; দারিদ্র্য, শিক্ষা ও বৈষম্যকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া; স্যানিটেশন, অবকাঠামো, পানির যথাযথ ব্যবহার; বেশিসংখ্যক ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে নীতি সহায়তায় আনা; পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া; মূলধারার নীতির সঙ্গে বিপন্ন জনগোষ্ঠী সম্পৃক্ত করা; রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুবিধা বৃদ্ধি; বৈষম্য রোধে নীতি বাস্তবায়ন; ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং কেউ পিছিয়ে থাকবে না, এ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।