মেয়র বলেছিলেন 'নভেম্বরে সব বদলে যাবে'

নীল ছিল মেয়র আনিসুল হকের প্রিয় রং। ছবি: খালেদ সরকার
নীল ছিল মেয়র আনিসুল হকের প্রিয় রং। ছবি: খালেদ সরকার

‘শোনো, নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকার চেহারা কেমন বদলে দিই দেখো। ইউরোপের রাস্তায় যেমন বাতি দেখা যায়, তেমন রাস্তার বাতি কিনব। যা করব, যতটুকু করব, ততটুকুই সেরা কিছু করতে চাই।’ এ বছরের জুন মাসে মেয়র আনিসুল হক তাঁর বনানীর বাসায় বসে বলছিলেন কথাগুলো। সেই নভেম্বর এল, ঢাকাও যেন সত্যি বদলে গেল! শোকের ছায়ায় ঢেকে গেল সেই মানুষটিকে হারিয়ে।

স্নিকার পরতেন িকন্তু মোজা পরতেন না
স্নিকার পরতেন িকন্তু মোজা পরতেন না

আনিসুল হক বলছিলেন, ‘তোমার হাতে সময় আছে তো? অন্য ইন্টারভিউয়ের মতো করে দিতে ইচ্ছে করছে না। কেন জানি গল্প করতে মন চাচ্ছে।’ তাতে সায় না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। এমন গল্প থেকে তো আমি ব্যক্তি আনিসুল হককে খুঁজে পাব। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল তাঁর জানি না। তিনিও বুঝতে পারছিলেন না, জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোতে কেন বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন। জীবনের নানা রঙের, দুঃখ-কষ্টের স্বাদ তিনি পেয়েছেন—সবচেয়ে আদরের সন্তানকে হারানোর কষ্ট, কখনো সর্বোচ্চ সফলতার অকৃত্রিম আনন্দ। সাফল্যকে কীভাবে দেখেন? উত্তরে আনিসুল হক বলেন, ‘সব সফল মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য থাকবেই। সেটা হলো কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতা। সঙ্গে ভাগ্যের বন্ধুত্বও লাগে।’

স্বাভাবিকভাবেই পরের প্রশ্ন, ভাগ্যে বিশ্বাস করেন? মেয়রের সরাসরি উত্তর, ‘হ্যাঁ করি। ভাগ্য অনুকূলে না থাকলে অনেক কিছুই আমার জীবনে ঘটত না।’

গত ১৮ জুন দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে খুঁজে পেয়েছিলাম ব্যক্তি আনিসুল হককে। তিনি কী পছন্দ করেন, কী করেন না, ব্যক্তিগত জীবনের গল্প জানা গেল। প্রথম আলোর বিশেষ ঈদসংখ্যা ‘ঈদ উপহার’-এর জন্য দুদিন ধরে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। প্রথম দিন কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা ছুঁয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আর পাঁচ মিনিট গল্প করব। তারপর তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসব।’ হেসে আবার বললেন, ‘অফিস টাইম শেষ, আমার ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়েই পৌঁছে দেব।’ আনিসুল হক নিজে গাড়ি চালিয়ে গুলশান থেকে গ্রিনরোডে পৌঁছে দিলেন। তবে প্রথম দিন ছবি তোলার কাজটা আমাদের হয়নি। তিনি বললেন, ‘শরীরটা ভালো নেই, মনে হয় ভার্টিগো। একটু ভালো বোধ করলে কাল ছবি তুলব। আমি নিজেই তোমাদের সময় জানিয়ে দেব।’

কথা রেখেছিলেন আনিসুল হক। পরদিন সকাল ১০টায় চলে এল মেসেজ, ‘১১টায় ফটোগ্রাফারকে নিয়ে চলে এসো।’ আমরা গেলাম, আনিসুল হক ছবি তুললেন। একাধিক পোশাকও পরিবর্তন করলেন। টিপটিপ বৃষ্টিতে বাগানে দাঁড়িয়েও ছবি তুলেছেন মেয়র। সাক্ষাৎকার ও ছবি তোলা শেষে গাড়িতে উঠে গেলেন। আমরাও ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ গাড়ির কাচ নামিয়ে আমাকে ডাকলেন আনিসুল হক। তিনি বললেন, ‘আমি লন্ডন যাচ্ছি। ফিরে এসে আবার গল্প হবে। আমার অনেক গল্প বাকি আছে...!’

স্মার্ট ছিমছাম

‘স্মার্ট মেয়র’ উপমা তাঁর জন্যই প্রযোজ্য ছিল। চালচলনে, কথাবার্তা, আচরণ কিংবা ফ্যাশনে সবকিছুতে তাঁর রুচির ছাপ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ছিমছাম সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করতেন। যদিও মেয়র হওয়ার পর স্ত্রী রুবানা হক বলতেন কিছুটা ফরমাল পোশাক পরতে। সেটি মেনে খুব ফরমাল কোনো অনুষ্ঠান স্যুট পরতেন। স্যুট পরলেও টাই পরা একদমই পছন্দ ছিল না। পাঞ্জাবি আর টি-শার্টই বেশি পরা হতো তাঁর। প্রাণোচ্ছল এই মানুষের প্রিয় রং গাঢ় নীল। ঘিয়া ও কালো রংও পরতেন মাঝেমধ্যে।

টি–শার্ট ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক
টি–শার্ট ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক

গত ১৯ জুন প্রথম আলোর বিশেষ ঈদসংখ্যা ‘ঈদ উপহার’-এর জন্য এই ছবি তোলার সময় তা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। গাঢ় নীল পাঞ্জাবি, কালো টি-শার্ট ও ছাই রঙা টি-শার্ট বেছে নিয়েছিলেন সেদিন। আনিসুল হক বললেন, ‘ছবিতে মোটা যেন না দেখায়। শরীরটা কয়েক দিন থেকে খারাপ, তাই ডায়েট করতে পারছি না ঠিকমতো। আমি আর তানিশা মানে আমার ছোট মেয়ে একসঙ্গে হাঁটি। কয়েক দিন ধরে হাঁটাও হচ্ছে না।’ ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে এভাবেই চলছিল গল্প। ছবি তোলার শেষের দিকে হঠাৎ আনিসুল হক বললেন, ‘শিরোপা আসো, একটা ছবি তুলি তোমার সঙ্গে। আমি মরে গেলে বলতে পারবে মেয়র আনিসুল হক জোর করে ছবি তুলেছে।’ আমি হেসে বলেছিলাম, কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনিও মজা করে বললেন, ‘প্রয়োজনে ভিডিও করে রাখো।’ প্রথম আলোর আলোকচিত্রী খালেদ সরকার সেই মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দী করলেন।

পায়ে শুধু স্নিকার পরা দেখে বলেছিলাম, বাড়িতে থাকার জন্য কি মোজা পরলেন না? ‘আরে না, স্নিকারের সঙ্গে মোজা পরি না।’ স্মার্ট উত্তর মেয়রের। কেনাকাটা করতে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে স্পেন ও ইংল্যান্ড গেলে মাসিমো দুত্তি ও মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ব্র্যান্ডের দোকানে একবার ঢুঁ মারতেনই। মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের প্যান্টগুলো ফিটিং হয় ভালো। সেখান থেকে প্যান্ট কেনা হয়। ড্রাক্কার নয়ের, মাইকেল কোর সুগন্ধি ব্যবহার করতেন সব সময়। হাতে থাকত পছন্দের সুইডিশ ঘড়ি। তবে তাঁর কাছে ব্র্যান্ড কোনো বিষয় ছিল না, আনিসুল হক মনে করতেন, দামি পোশাক পরলেই ‘ভ্যালু ফর মানি’ হয় না। নিজের পোশাক কারখানা থেকে পাঞ্জাবি বানিয়ে নিতেন, আবার পছন্দ হলে একই রকম পোশাক অনেকগুলো কিনতেন।

আগের দিন (১৮ জুন) সন্ধ্যায় গিয়ে দেখছিলাম টিভিতে হিন্দি একটা সিনেমা দেখছেন। ভেবেছিলাম, হয়তো দেখছিলেন না, এমনিই টিভি চলছিল। আমার ভুল ভাঙিয়ে আনিসুল হক বললেন, ‘হিন্দি সিনেমা দেখতে ভালো লাগে। বিনোদনের খোরাক জোগায়। আমি কিন্তু খুব গান শুনতে ভালোবাসি। সব ধরনের গান গাড়িতে যেতে যেতে শোনা হয়।’

আনিসুল হক সকাল সাতটায় উঠে ব্যায়াম করতেন নিয়মিত। প্রিয় খাবারের কথা উঠতেই তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি লিখবে—আনিসুল হক হলেন ডাল-ভাতের বাঙালি।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, নতুন নতুন খাবারের স্বাদ পছন্দ করেন। ক্রিসপি ফ্রায়েড চিকেন তাঁর প্রিয়। আনিসুল হকের বনানীর বাসার লিভিং রুমে তাঁর সঙ্গে আমরাও কফি মগে চুমুক দিচ্ছিলাম। আনিসুল হক নিজেই বলছিলেন, ‘দুটো জিনিস আমি খাই না—চা পান করি না আর সিগারেট খাই না। শুধু সকালে ও রাতে খাওয়ার পর দুই বেলা কফি পান করি।’

 ‘গুড টাইমিং’ বলে একটা বিষয় আনিসুল হকের জীবনে সব সময়ই ঘটেছে। সে জন্য ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস ছিল তাঁর। বড় মেয়ের বিয়েতে কত আনন্দ করেছিলেন, ছেলে নাভিদ খুব দায়িত্ববান, স্ত্রী রুবানা হকের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে সবই তিনি বলেছিলেন সেদিনের সন্ধ্যায়। আনিসুল হক বলছিলেন, ‘আমার সংসার-জীবন সব সহজ হয়েছে রুবানার কারণে। ওর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কোনো কিছুতে হাল ছাড়ে না। ঠান্ডা মাথায় সব সামলাতে পারে।’ স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রগাঢ়তা টের পাচ্ছিলাম।

কথার জাদুকর

কারও কথা এমন মাধুর্যময় হতে পারে, তা না শুনলে বোঝা যাবে না। শব্দের সম্মোহনী শক্তি বোধ হয় একেই বলে। একসময়ের জনপ্রিয় এই উপস্থাপকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর উপস্থাপনা করবেন না? আবার কোনো দিন কি দেখতে পাব? বেশ একচোট হেসেছিলেন। আনিসুল হক তখন বলেছিলেন, ‘আজকাল কথা বলা নিয়ে প্রায়ই ভয়ে থাকি, কী বলতে কী বলে ফেলি। তাই বড় কোনো ধারাবাহিক অনুষ্ঠান আর করতে চাই না।’ ‘সবিনয়ে জানতে চাই’, ‘জলসা’ বা ‘অন্তরাল’-এর মতো কোনো অনুষ্ঠান করার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হলে ভেবে দেখবেন, তাও জানিয়েছিলেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। এ ব্যাপারে আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘একবার আমি আপাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেছিলাম, পরে মনে হয়েছিল সেটি ঠিক হয়নি। আপা নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তাই তিনি আমাকে মেয়র হওয়ার জন্য মনোনীত করেছিলেন। যেকোনো সমস্যা হলে আপাকে ফোন দিই। সব সমস্যা শোনেন, বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান দেন। ট্রাকস্ট্যান্ড ওঠানো ও দূতাবাসগুলোর সামনে থেকে ফুটপাতের ব্যারিকেড তুলে দিতে চারপাশ থেকে চাপ পেয়েছি। আপাকে বলেছি, তিনি বলেছেন পাশে আছেন আমার। চালিয়ে যাও।’

জীবনের অন্যতম একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন আনিসুল হক। তিনি বলেছিলেন, ‘সবিনয়ে জানতে চাই অনুষ্ঠানে একবার ডেইলি স্টারের  সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম ও সাংবাদিক মতিউর রহমানকে (বর্তমানে প্রথম আলোর  সম্পাদক), আওয়ামী লীগ নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখোমুখি করেছিলাম। গঠনমূলক প্রশ্নপর্ব হয়েছে, পরস্পরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আমার মনে হয় না, এখন তেমন রাজনৈতিক পরিবেশ আছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান করার কথা এখন কেউ ভাবতে পারে? আগে যে মানের অনুষ্ঠান করেছি, তার থেকে ভালো কিছু তো করতে হবে। খারাপ কিছু তো করতে পারব না।’

আনিসুল হক আরও বলছিলেন, ‘ইমেজ খারাপ হওয়ার জন্য একমুহূর্তের একটা ভুলই যথেষ্ট। ধরো ফজলে লোহানী কী ভীষণ জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন, কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে ১৭ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান করেই তাঁকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। আমাকেও তো ডাকা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান করার জন্য। ওই যে বলছিলাম ভাগ্যে বিশ্বাস করি। সেদিনও ভাগ্য আমার সহায় ছিল। আমি কৌশল করে এড়িয়ে গেছি। জনপ্রিয়তা ধরে রাখা খুব কঠিন কাজ।’

পরিবারই ছিল সব

মা-বাবা ও ভাইদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ তিনি। কতবার ব্যবসা করার জন্য টাকা নিয়েছেন। একবার ঢাকার বাইরে গেলেন পাট কিনতে। পাট কিনে ফেরার সময় ট্রাকচালক ফন্দি করে আনিসুল হককে প্রহার করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। সেবার তাঁর মনে হয়েছিল, এ জীবনে কিছু হবে না। কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কোনো কিছুতে সহজে দমে যেতেন না।

ভাইদের কথাও বলেছিলেন আনিসুল হক—‘বাবা চেয়েছিলেন চার ছেলের একজন অন্তত সেনাবাহিনীতে যাক। আমাকে দিয়ে হলো না। তখন আমার ভাই যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ভাইয়ের খুব ইচ্ছা ছিল তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়বেন। তাঁর পড়া হলো না, আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করলেন। সেই ভাই বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান।’

কথায় ঘুরে-ফিরে আসছিল ছোট মেয়ে তানিশার কথা। ছোট মেয়ে তানিশাকে বাবা আনিসুল হক মনে করতেন হাসির ফোয়ারা। যত ব্যস্ততাই থাকুক ছোট মেয়ের সঙ্গে রাতে গল্প করা চাই। এই সময়টিকে সবচেয়ে মধুর সময় মনে হতো মেয়রের। মুহূর্তেই সব ক্লান্তি হাওয়া হয়ে যেত তাঁর। সাক্ষাৎকারের সময় বলেছিলেন, ‘অনেক দিন ধরে মনে মনে একটা পরিকল্পনা করেছি। ভারতের সব প্রদেশ ঘুরে দেখার ইচ্ছা। এই বছর কাজ গুছিয়ে সামনের বছর চেষ্টা করব তানিশাকে নিয়ে ভারত ভ্রমণে যাওয়ার। নেহাত ঘোরার জন্য খুব একটা ঘোরা হয়নি। মনের গোপন ইচ্ছা হলো, একটা ব্যক্তিগত ভ্রমণে যাব পরিবারের সবাইকে নিয়ে। সেটা হতে পারে কোনো ঐতিহাসিক স্থান। তখন কোনো কাজ রাখব না। শুধু আনন্দ করব আর ঘুরব...।’

আমাদের স্মার্ট মেয়রের মনের একান্ত ইচ্ছা একান্তই থেকে গেল। স্বপ্ন দেখা মানুষটি নিজের এই ছোট্ট স্বপ্ন পূরণ না করে চলে গেলেন। আর বাবার আদরের মেয়ে তানিশা এখন প্রতি রাতে নিশ্চয় মনে মনে বাবার সঙ্গে গল্প করে...।