ঝুঁকিপূর্ণ, তবু গভীর নলকূপ প্রীতি কমছে না ওয়াসার

রাজধানী ঢাকার মাটির নিচের পানির স্তর বিপজ্জনক হারে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ ব্যাপক হারে বসানো ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য ঢাকা ওয়াসা ২০০৯ সাল থেকেই মাটির নিচের পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর কথা বলে আসছিল। কিন্তু অনেক আগে শুরু হওয়া সায়েদাবাদ শোধনাগারের দ্বিতীয় পর্ব চালু ছাড়া নতুন শোধনাগার হয়নি।

২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তাকসিম এ খান সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, গভীর নলকূপ কম বসিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। অথচ বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে প্রায় ৯ বছরে ঢাকায় ৩৩৭টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, নতুন ৩৩৭টি গভীর নলকূপ বসাতে এবং এগুলোর পাম্প স্টেশন বানাতে ৯ বছরে প্রায় ৫৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এগুলোর পেছনে খরচ হচ্ছে গড়ে ১৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ওয়াসার মোট ৮১৯টি পাম্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার পানি প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০-১১ সালে একটি গভীর নলকূপ বসাতে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা খরচ হতো। পাম্প স্টেশন স্থাপনে এর সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হতো আরও অন্তত ২০ লাখ টাকা। এখন একটি গভীর নলকূপ বসাতেই ১ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এর সঙ্গে পাম্প স্টেশন তৈরিতে মোট প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ হয়। তিনি স্বীকার করেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ায় নলকূপ বসাতে গিয়ে এলাকাভেদে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত পাইপ নিয়ে যেতে হয়। আগে যদি ৫০০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, এখন যেতে হচ্ছে ১ হাজার ফুট গভীরে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীতে প্রতিবছর গড়ে তিন মিটার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপ বেশি স্থাপন ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সময় ঝুঁকি বাড়ায়। ২০০৯ সালের শুরুতে রাজধানীতে ওয়াসার ৪৮২টি গভীর নলকূপ ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৯টিতে। এগুলো এবং দুটি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২৪৫ কোটি লিটার পানি।

* ৯ বছরে ৩৩৭টি গভীর নলকূপ স্থাপন
* নলকূপের পেছনে ৫৯৩ কোটি টাকা খরচ

২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসার ‘ঘুরে দাঁড়াও’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তখন তাকসিম এ খান ঘোষণা দেন, ঝুঁকি কমাতে মাটির নিচের পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ (নদী) পানি শোধন করা হবে। ওই সময়ে তিনি হিসাব দিয়েছিলেন যে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৮৩ শতাংশই ভূগর্ভস্থ। আর ১৭ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি। এটাকে উল্টো করে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সায়েদাবাদ শোধনাগারের দ্বিতীয় পর্ব চালুর কারণে এ ক্ষেত্রে মাত্র ৯ শতাংশ উৎপাদন যোগ হয়েছে।

তাকসিম এ খান প্রথম আলোকে বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার চালু হবে। এটা চালু হলে ওয়াসার সরবরাহ লাইনে যোগ হবে ৪৫ কোটি লিটার পানি। এ ছাড়া খুব তাড়াতাড়ি সাভারের ভাকুর্তায় বসানো ৪৬টি পাম্প থেকে ১৫ কোটি লিটার পানি ঢাকার মিরপুরে আনা সম্ভব হবে। ২০২১ সালের মধ্যে আরও একাধিক শোধনাগারের পানি যোগ হবে।

২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সায়েদাবাদ দ্বিতীয় পর্ব চালুর পর কমপক্ষে ১৭ কোটি লিটার পানি উদ্বৃত্ত থাকার কথা প্রচার করে ওয়াসা। ওই সময়ে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়, পানির অপচয় কমাতে ৭০টি পাম্প বন্ধ রাখা হবে। বিশেষ করে সায়েদাবাদের পানি যেসব এলাকা পথে সরবরাহ হয়, সেসব এলাকার পাম্প বন্ধ করে সাশ্রয় করা হবে। যেমন ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার এলাকা, শ্যামলী, কল্যাণপুর, নতুনবাজার ও মিরপুর বাঙলা কলেজ এলাকা।

পানির স্তর নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ কম বসানোর অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দিলে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন গভীর নলকূপ বসানোর কারণেই ঢাকায় এখন পানির কোনো সংকট নেই। বরং উদ্বৃত্ত আছে। তিনি বলেন, সব শোধনাগার চালু হলে নতুন গভীর নলকূপ আর বসবে না।

মধ্যবর্তী সময়ে এত অর্থ খরচ করে বসানো গভীর নলকূপ ও পাম্পগুলোর কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাব দেননি ঢাকা ওয়াসার এমডি। তবে পানি প্রকল্পের পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বর্তমানে অনেক পাম্প ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টাও চলে। সব শোধনাগার চালু হলে কম সময় চালানো হবে। তবে ওয়াসার প্রশাসন বিভাগ থেকে জানা যায়, ওয়াসার পাম্প চালাতে বর্তমান দেড় হাজার অপারেটর রয়েছে। আরও এক হাজার অপারেটর নিয়োগের বিষয় প্রক্রিয়াধীন আছে। এগুলো স্থায়ী পদ।