অভিযোগ করে আরও বিপাকে ব্যবসায়ীরা

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) রমনা অঞ্চলের পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অপহরণ-চাঁদাবাজির অভিযোগ করে উল্টো বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। নানাভাবে এখন তাঁদের মিটমাট করে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেউ কেউ হয়রানি এড়াতে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও আসছেন না। এঁরা সবাই সিএনজিচালিত অটোরিকশার ডিলার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত আগস্ট থেকে কমপক্ষে চারজন ব্যবসায়ীকে ডিবির রমনা অঞ্চলের দল তুলে নিয়ে মারধর করে চাঁদা আদায় করেছে। সর্বশেষ গত ১৯ নভেম্বর একজন ব্যবসায়ীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোক্তার হোসেনের কাছে যান। তিনি বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে জানান। মন্ত্রী অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেনকে নির্দেশ দেন। এরপর ডিবির রমনা অঞ্চলের পরিদর্শক বাহাউদ্দিন ফারুকি এবং তিন উপপরিদর্শক মিন্টু, পলাশ ও মুন্সী সাইফুলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তের ফলাফল সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।

ভুক্তভোগী কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেছেন, পুলিশ বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁদের তদন্ত কমিটিতে হাজির না হতে চাপ দিচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর মগবাজার রেলগেট, মধুবাগ ও মীরেরবাগে বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তাঁরা মূলত উত্তরা মোটরস থেকে সিএনজি কিনে এনে বিক্রি করেন। প্রত্যেকই অবস্থাপন্ন। তাঁরা নিয়মিত সরকারকে বড় অঙ্কের কর দেওয়ার কাগজপত্রও এই প্রতিবেদককে দেখান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কারী এই দলের প্রধান হলেন গাড়িচোর ধরা দলের দায়িত্বে থাকা ডিবির (দক্ষিণ) একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার। তিনি এখন বিদেশে। তাঁর অনুপস্থিতিতে ডিবির (দক্ষিণ) সহকারী কমিশনার রবিউল আরাফাত (লেনিন) দায়িত্ব নিয়েছেন। আর, ব্যবসায়ীদের তুলে আনার কাজ করেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক ও উপপরিদর্শকেরা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, মগবাজার রেলগেট এলাকায় ডিবির ‘সোর্স’ (তথ্যদাতা) হিসেবে কাজ করেন সোহেল ও মিয়া মো. আমিন। মিয়া মো. আমিন সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল আরাফাতের খালাতো ভাই। কোন কোন দোকান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বেশি বিক্রি হয়েছে এই তথ্য সোহেল ডিবিকে জানায়। তখন ডিবির দল ওই ব্যবসায়ীদের তুলে নিয়ে যায়। তাঁদের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে মধ্যস্থতা করেন ‘সোর্স’ মিয়া মো. আমিন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে এসি রবিউল আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। ব্যবসায়ীরা কেন তাঁর নাম জড়াচ্ছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। যাঁরা অভিযোগ তুলছেন, তাঁদের তিনি কখনো দেখেননি।

অন্যদিকে রবিউল আরাফাতের খালাতো ভাই ও ডিবির সোর্স মিয়া মো. আমিন দাবি করেন, তাঁর ভাই পুলিশে আছেন বলে ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়লে তিনি সাহায্য করেন। শুধু শুধু তাঁকে ও তাঁর ভাইকে জড়ানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে গাড়িচোর ধরা টিমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আর তাঁর ভাই (রবিউল আরাফাত) আছেন মাদক ধরা টিমে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই দলটির উৎপাত শুরু হয় এ বছরের ২৯ আগস্ট। ওই সন্ধ্যায় নান্টু নামের একজন ব্যবসায়ীকে উপপরিদর্শক মুন্সী সাইফুল ইসলাম মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে নেন। একই সময়ে অন্য মোটরসাইকেলে ছিলেন উপপরিদর্শক পলাশ। এক দিন পর ৩০ আগস্ট রাতে আট লাখ দিয়ে তাঁকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনেন স্বজনেরা।

পরের ঘটনাটি ঘটে ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন দিগন্ত অটো সেন্টারের মালিক কমল কুমার রায়কে ডিবির একটি দল মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। ওই মাইক্রোবাসে পরিদর্শক বাহাউদ্দিন ফারুকি, উপপরিদর্শক পলাশ, মিন্টু ও মুন্সী সাইফুল ছিলেন। ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধৃত করে তাঁর একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, ডিবির সদস্যরা কমল কুমারের চোখ বেঁধে ফেলেন, পরে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখেন। টাকা না পেলে তাঁরা কমলকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন। পরে মিয়া মো. আমিনের মাধ্যমে ১১ লাখ টাকা ডিবি অফিসে পাঠানোর পর তিনি ছাড়া পান। গত ১৪ অক্টোবর ডিবির একই দল ইমরান হোসেন খন্দকার নামের একজন ব্যবসায়ীকে তাঁর দিলু রোডের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর স্ত্রী ও ভাগনে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন।

সবশেষ ঘটনাটি ঘটে গত ১৯ নভেম্বর। ডিবির দলটি এস এম অটো সেন্টারের মালিক মো. বিল্লালকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর এক বন্ধু প্রথম আলোকে বলেন, বিল্লালের বাসা মিয়া মো. আমিন ছাড়া আর কেউ চিনত না। ডিবি অফিসে অত্যাচারে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ডিবি তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা দাবি করে। অন্যথায় ইয়াবা দিয়ে তাঁকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। পরে বিল্লাল জানতে পারেন, মিয়া মো. আমিন তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলেন, তাঁর স্বামী খুব বিপদে আছেন। তাঁকে খুব মারধর করা হচ্ছে। বাঁচাতে চাইলে তখনই টাকা দিতে হবে। মো. বিল্লালের স্ত্রী তখন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ডিবি অফিসে পৌঁছান। এ ছাড়া ওই এলাকার একজন ব্যবসায়ী অপহরণের ভয়ে আগেভাগেই এক লাখ টাকা দিয়ে রেখেছেন বলে জানা গেছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তাঁরা সবাই মিলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোক্তার হোসেনের কাছে যান। তিনিই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই এলাকার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ডিবির টিম প্রায়ই আসে। ব্যবসায়ীরা একটু লাভ করলে আর রক্ষা নেই। ডিবির কানে এই তথ্য যাবেই এবং তাঁদের চাঁদা দিতে হবে।

 অপর একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিপদে পড়লে তাঁরা একটা সময় প্রশাসনের কাছে যেতেন। এখন প্রশাসনের ভয়ে পালিয়ে থাকেন। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ বিষয়ে জানেন না। তিনি বলেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।