ফাদার রিগনের দিনলিপি

ফাদার মারিনো রিগন
ফাদার মারিনো রিগন

পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত নানা বয়সী পাঁচজন মানুষ ১৯৭১ সালের ২১ মে বানিয়ারচরে এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে। আহত ব্যক্তিদের একজন বিকম দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ তাঁর হাতটি বিচ্ছিন্নপ্রায়। অন্য হাতে গুলিবিদ্ধ তাঁরই শিশুসন্তান। চিকিৎসার জন্য পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বানিয়ারচরে পৌঁছেছিলেন তাঁরা। কেননা, সেখানে ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে আছে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র।

আহত তরুণ নিজের সন্তানকে দেখিয়ে গির্জার ধর্মযাজক ফাদার মারিনো রিগনকে বলছিলেন,
‘ফাদার, খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। এমন ইনজেকশন দিন, যাতে পুরোপুরি মরে যায়।’ অসহায়ের মতো কাঁদছিলেন তরুণের স্ত্রী।

ওই দিনের দিনলিপিতে এ ঘটনা টুকে রেখেছিলেন ফাদার রিগন। সে সময় গোপালগঞ্জের মকছুদপুরের বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর দিনলিপির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে যুদ্ধের দিনগুলোর এমন নানা ঘটনা।

ফাদার রিগন গির্জার চিকিৎসাকেন্দ্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু চিকিৎসাই করেননি, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় নিরীহ মানুষদের গির্জার আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের লুকিয়ে রেখেছেন, শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে খাবার ও আশ্রয় দিয়েছেন। এভাবে তিনি শামিল হয়েছিলেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর দিনলিপি একাত্তরের যুদ্ধদিনের এক অমূল্য স্মারক।

ইতালীয় ভাষায় লেখা সেই দিনলিপি এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। জীবদ্দশায় ফাদার রিগন নিজেই সেই স্মৃতিকথা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেই পাণ্ডুলিপিতে এক দিনের ভুক্তিতে তিনি লিখেছেন, ‘চিকিৎসা নিতে আসে ১০ বছরের এক বালিকা। আতঙ্কে বোবা হয়ে গিয়েছিল সে। পাতার মতো কাঁপছিল শুধু। তার চোখভর্তি ছিল জল।’

একাত্তরে ফাদার রিগনের কর্মস্থল বানিয়ারচর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল বহু মানুষ। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখানকার খ্রিষ্টান সমাজের কেউ কেউ শুরুতে তাদের জায়গা দিতে আপত্তি করেছিলেন। সাপ্তাহিক এক প্রার্থনাসভায় ফাদার রিগন তাঁদের বলেছিলেন, ‘আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো তো যিশুরই শিক্ষা।’ এতে উদ্বুদ্ধ হন এলাকাবাসী।

মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখযুদ্ধে শত্রুকে ঘায়েল করেছেন। নেপথ্যের যোদ্ধারা চিকিৎসা দিয়েছেন আহত যোদ্ধাদের।

যুদ্ধ শুরু হলেও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ফাদার রিগন ইতালিতে নিজের বাড়িতে ফিরে যাননি। এমনকি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে কর্মরত বন্ধুস্থানীয় সহকর্মী ফাদার মারিও ভেরোনেসির নির্মমভাবে খুন হওয়ার খবর জানার পরও না। বাংলাদেশের একজন হয়ে মানুষের পাশে ছিলেন এই সন্ত। হানাদার বাহিনী বানিয়ারচরে এলে গির্জার বাইরে পায়চারি করতেন ফাদার। কেননা, গির্জার ভেতরে অনেক হিন্দুধর্মাবলম্বী তাঁদের পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী এসে জিজ্ঞেস করত ‘মালাউন’ আছে কি না। ফাদার বলতেন, ‘ভেতরে সবাই আমার লোক।’

বানিয়াচর নিবাসী জে কে এম বি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইকেল বাড়ৈ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জানান, একবার পাকিস্তানি সেনারা ফাদার রিগনের দিকে বন্দুক তাক করেছিল। স্থানীয় এক বাঙালিকে দিয়ে তাঁর দেহ তল্লাশিও করিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মে রিগনের দিনলিপি থেকে জানা যায়, পলিতা ও সেন্দিয়া গ্রামে সেদিন আগুন দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। সামনে যাদের পেয়েছে, হত্যা করেছে। সেন্দিয়া গ্রাম সেদিন যেন শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ১ হাজার ২৭ জনকে মেরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। মা-বাবাহারা এক শিশুকে সেখান থেকে উদ্ধার করে ফাদার নিয়ে আসেন বানিয়ারচরে। ফাদারের তত্ত্বাবধানে মাইকেল বাড়ৈয়ের পরিবারে বড় হয় সে। ফাদার তার নাম দেন মোশি। এই শিশু হয় বাড়ৈদের পঞ্চম ভাই।

বানিয়ারচরের গির্জার চিকিত্সাকেন্দ্রটিকে ফাদার বানিয়েছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাকেন্দ্র। তাঁর তত্ত্বাবধানে সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সরা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সা দিতে শুরু করেন। পাকিস্তানি বাহিনী এ খবর যাতে জেনে না ফেলে, সে জন্য তিনি চিকিৎসার কাজ করতেন রাতে।

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলাদল হেমায়েত বাহিনীর কথা জানা যায় ফাদারের দিনলিপি থেকে। ২৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে দলনেতা হেমায়েত উদ্দীন গুলিবিদ্ধ হন। ভয়াবহ আহত হেমায়েতকে তাঁর সঙ্গীরা চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন ফাদার রিগনের চিকিৎসাকেন্দ্রে। জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে হেমায়েত উদ্দীন বীর বিক্রম বলেছিলেন, ‘সেদিন ফাদার রিগনের চিকিত্সা না পেলে হয়তো বাঁচতাম না।’

১৯৫৩ সালে ২৮ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছিলেন মারিনো রিগন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে বানিয়ারচর মিশন থেকে পরিচালনা করা চারটি নৌযানের নাম ফাদার রেখেছিলেন ‘মুক্ত বাংলা’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘স্বাধীন বাংলা’ ও ‘সংগ্রামী বাংলা’।

মোংলায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল। দুস্থ-অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য ১৯৮৩ সালে সেখানে একটি সেলাইকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সেখানে তৈরি পণ্য ইতালিতে বিক্রি হতো। সমবায় সমিতি গড়েছিলেন, চাষের জন্য পাওয়ার টিলারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলা শিখেছিলেন ফাদার। ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্‌দীন ও লালনের সাহিত্য।

অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ফাদার রিগনকে সম্মানজনক নাগরিকত্ব দেয়। ২০১২ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।

গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তিনি ইতালি গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। গত ২০ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে ইতালিতে মারা যান তিনি। খুলনার ক্যাথলিক মিশন সরকারের কাছে আবেদন করেছে, ফাদারের কফিনটি যেন বাংলাদেশে এনে এখানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ফাদার রিগন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনে একটি কঠিন সময়। আমি অনেক সময় মজা করে বলি, আমি তখন মুক্তিবাহিনীর মুক্তিবাহিনী ছিলাম।’