মানবাধিকার কমিশনকে পাত্তা দিচ্ছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

গত পাঁচ বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৮৫টি ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিবেদন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু মন্ত্রণালয় এই সময়ে একটি চিঠিরও কোনো জবাব দেয়নি। এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার অনুসন্ধানের চেয়ে সভা-সেমিনার ও সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কমিশন। বছরজুড়ে অসংখ্য গুম, নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা ঘটলেও গত এক বছরে কমিশন মাত্র চারটি ঘটনার অনুসন্ধান করেছে। এই প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে বেশির ভাগ অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে। আমরা যখন এসব অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাই, তখন তাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাই না, যা আমাদের হতাশ করেছে।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী কমিশন সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা তাদের সদস্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে নিজ উদ্যোগে বা দরখাস্তের ভিত্তিতে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারবে। সরকারকে ওই প্রতিবেদন দ্রুত কমিশনকে দিতে হবে। এ ব্যাপারে কমিশন কোনো সুপারিশ করলে তা বাস্তবায়ন করে ছয় মাসের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে। কমিশনের অভিযোগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে মানবাধিকার কমিশন থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে তিনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। কেন তাঁরা এসব ঘটনা তদন্ত করেননি, তা তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।

কমিশনের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ নিয়ে কমিশনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা সচিবের সঙ্গে যোগযোগ করে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অনুরোধ জানানো হয়েছে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে। সবাই বলেছেন ব্যবস্থা নেবেন, কিন্তু কেউই কিছু করছেন না।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ও সাবেক সচিব মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের উচিত “রেসপন্স” করা। পুরোনোগুলো শেষ না হওয়ায় নতুন ঘটনা নিয়ে আমরা দৌড়ঝাঁপ করতে পারছি না।’

মানবাধিকার কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে গত ৯ নভেম্বর বলা হয়েছে, গুম, অপহরণ ও নিখোঁজ হওয়া মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন না পেয়ে ৩ ডিসেম্বর তাগাদা দেওয়া হয়। গতকাল পর্যন্ত তারও কোনো জবাব মেলেনি।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৪টি, ২০১৩ সালে ১০টি, ২০১৪ সালে ৫৩টি, ২০১৫ সালে ৭৩টি, ২০১৬ সালে ১৬ টি এবং ২০১৭ সালে ২৯টি অভিযোগ পাঠানো হয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের তথ্যে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম ৬ মাসে ৫২ ব্যক্তি গুমের শিকার হন। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৮৭ জন। পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে ১২৬টি। কিন্তু এসব বিষয়ে কমিশন কিছুই করতে পারছে না।

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মী থেকে সাবেক রাষ্ট্রদূত—গুমের শিকার থেকে কেউ বাদ যায়নি। এমন একটি পরিস্থিতিতে মানবাধিকার কমিশনের এসব বিষয়ে নজর না দেওয়ার বিষয়টি তাদের ব্যর্থতার কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। কমিশনের এই ভূমিকা না নেওয়ার বিষয়টি আমাদের হতাশ করেছে।’

গুমের ঘটনার বিষয়ে কমিশন একটি কাজই করেছে তা হলো, সভা করে এর নিন্দা করা। অব্যাহতভাবে গুম ও অপহরণ বেড়ে যাওয়ার পর গত আগস্ট মাসে কমিশনে এক সভা করে এসব ঘটনাকে ‘নিন্দনীয়’ বলে আখ্যায়িত করেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।

গুমের ঘটনায় কোনো তথ্যানুসন্ধান নেই কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, ‘গুম এমন একটি বিষয়, এর তদন্ত করার মতো মেশিনারি আমাদের নেই। কারণ, সেখানে স্পটে গিয়ে তো কাউকে পাওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, গুম বা বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তদন্তের ঘাটতির জন্য প্রতিষ্ঠানের কম লোকবল একটা কারণ বলে জানান তিনি।

গত এক বছরে মোট চারটি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন দেয় কমিশন। এর মধ্যে নাসিরনগরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা, টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে সংঘটিত দুর্ঘটনা, রাঙামাটির লংগদুতে হামলা এবং রাঙামাটির নানিয়ারচরে রোমেল চাকমা নামের এক তরুণের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হওয়ার ঘটনা। এর মধ্যে গুরুতর রোমেল হত্যার প্রতিবেদনে এভাবেই সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন: ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় যদি কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়, তবে তার দায়ভার সংশ্লিষ্টরা এড়িয়ে যেতে পারে না।’

সুলতানা কামাল বলেন, ‘এভাবে একটি খুনের ঘটনায় সমাপ্তি টানা যথেষ্ট নয়। এ ধরনের প্রতিবেদন দুর্ভাগ্যজনক।’

গত এক বছরে একটিও গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত না হলেও এ ধরনের তদন্ত করার অতীত উদাহরণ আছে কমিশনের। ২০১৪ সালে যশোরে রজব আলী নামের এক ব্যক্তির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্ত করে কমিশন। কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট করে বলে, ‘রজব আলীর নিহত হওয়ার ঘটনাটি বন্দুকযুদ্ধ নয়। পুলিশের গুলিবর্ষণও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হয়নি।’ কমিশন সূত্র বলছে, গত এক বছরে ১৮টি গুমের অভিযোগ তারা পেয়েছে। এর একটিরও তদন্ত নিজেরা বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানোর কোনো উদ্যোগ কমিশন নেয়নি।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কমিশনের কাছে আসবে। কমিশনকে তাদের কথা শুনতে হবে। কমিশন যদি যথাযথভাবে সেসব বিষয়ে দৃষ্টি না দেয়, তবে সাধারণ মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তফাত কী থাকল?