মায়ের কাছে ফেরা

>

একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠরা বাংলাদেশের চিরকালের নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সেসব রুদ্ধশ্বাস সমরে তাঁদের বীরোচিত আত্মত্যাগ আমাদের চিরন্তন প্রেরণা জোগায়।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান

হামিদুর ছেলেটা গায়েগতরেই বেড়েছেন। পেশল বাহু, চিতানো বুক, পেটানো হাত-পা। নাকের নিচে গোঁফের রেখা। আসলে তো কিশোরই। বয়স কত হবে? ১৮? কিংবা এক বছর কম বা বেশি। মনের বয়সে তিনি কিশোরই রয়ে গেছেন।

ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলেন, ‘সিপাহি হামিদুর।’

‘স্যার।’

হামিদুর ক্যানভাসের জুতা মাটিতে ঠুকে স্যালুট দেন। নামের আগে সিপাহি পরিচয়টা তাঁকে খুশি করে তোলে।

‘তোমার হাতের ডাল রান্নাটা কিন্তু পৃথিবীর এক নম্বর। আমাদের লঙ্গরখানার বাবুর্চি আক্কেল আলীর ডাল যা হয়, তাকে ঠিক পাক করা বলে না। ওটা হলো ঘুঁটা। তোমারটা হলো পৃথিবীর এক নম্বর। কী বলো?’

‘স্যার। সিপাহি আপনার কথায় একটুখানি ওজর-আপত্তি করে স্যার।’

‘আমার কথায় ওজর! বলো কী!’

‘আপনি পারমিশন দিলে বলতে পারি স্যার।’

‘পারমিশন দিচ্ছি। বলো। শুনি তোমার কী আপত্তি!’

সিপাহি হামিদুর তাঁর হাত দুটো একত্র করেন। বিনয়ের ভঙ্গি আনেন চেহারায়। হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, ‘স্যার, পৃথিবীর সেরা ডাইলটা পাক করে আমার মা। আমার মায়ের হাতের পাক করা ডাইল যদি খেতেন, তাহলে স্যার কী যে বলতেন। জান্নাতি সুবাস। মায়ের হাতের ডাইলের কোনো তুলনা হয় না স্যার। আল্লাহ বাঁচি থুলে দেশ স্বাধীন হলে আপনাকে খাওয়াব স্যার। আপনার কথা মাকে কত বলিছি। মা অনেক দোয়া করিছেন। বলেছেন, তোর স্যারের এক শ বছর পরমায়ু হবে। নেকদার আদমি।’

‘তাহলে তুমি বোধ হয় ডাল পাক করার কায়দাটা মায়ের কাছ থেকেই শিখেছ। তোমার রান্নার হাতও খুব ভালো।’

‘স্যার। সেটি হয়তো ঠিক কয়ে থাকবেন। আমার মা তো পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে। চব্বিশ পরগনার ডুমিয়া থানার চাপড়া গ্রামে ছিলেন তাঁরা। পাকিস্তান হওয়ার পর ইন্ডিয়া থেকে এই পারে চইলে এসেছেন। আসার সময় আর তো কিছু সাথে করে আনতে পারেননি। ডাইল আর লাবড়া পাক করার কায়দাকানুন সাথে করে এনেছেন।’ বলে সিপাহি হামিদুর হাসেন। তাঁর দাঁতগুলো ঝকঝকে। তাঁর কচিমুখে দাঁতগুলোকেই সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ে। আর হাসলে তাঁর চোখের তারাও ঝিলিক তোলে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম স্নেহের চোখে তাকান। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেটা তাঁকে চেপে ধরতে হবে। তিনি সৈনিক। আছেন যুদ্ধের ময়দানে। এখানে মায়া-মমতার স্থান যে নেই বললেই চলে।

ত্রিপুরার এক পাহাড়ের ঢালে তাঁদের ক্যাম্প। একটা মিউনিসিপ্যাল অফিসের লাগোয়া দুটো টিনে ছাওয়া পাকা ঘর। তারই পাশে ঘন গাছগাছালির আড়ালে তাঁবু। সেই তাঁবুর রংও ধূসর। দূর থেকে দেখে কেউ বুঝবে না এখানে ক্যাম্প গাড়া হয়েছে। মাঠে সবুজ ঘাস। এই এলাকায় বৃষ্টি হয় খুব বেশি। পশ্চিম দিকে শ্রীমঙ্গল। চা-বাগান সীমান্তের ওপার-এপার—দুই পারেই। সমান মাপে কাটা চা-বাগানের মাথার ওপারে ছায়াবৃক্ষের সারি।

পশ্চিমাকাশে কে যেন হলদি গুঁড়া ছিটিয়ে দিয়েছে। অস্তরাগ এসে পড়েছে হামিদুর রহমানের মুখের এক পাশে। চুলের এক পাশটায় রঙিন আলো ওর মুখে শৈশবের লালিত্যকে উসকে দিতে চাইছে। কিন্তু তাঁর শক্ত চোয়াল ফুটিয়ে তুলতে চাইছে সৈনিক জীবনের দৃঢ়তা। অবরুদ্ধ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তাঁরা লড়ছেন। ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে তাঁরা প্রায়ই ঢুকে পড়ছেন দেশের ভেতরে।

হামিদুর বলেন, ‘স্যার। আপনার কথা শুনে আমার আরেকটা কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলি?’

‘বলো।’ কাইয়ুম বসে আছেন একটা টিপয়ের ওপর। মিউনিসিপ্যাল ঘরটার বারান্দায়। হামিদুর রহমান মাঠে।

হামিদুর বলেন, ‘স্যার। আপনি বললেন না পাক করার কায়দার কথা। আমার মায়ের নামও স্যার কায়দা।’

কাইয়ুম বলেন, ‘মানে?’

‘আমার মায়ের নাম স্যার কায়েদাতুননেসা। তাইলে স্যার কায়দাই হলো না?’

‘তা হলো।’

‘আর তোমার বাবার নাম?’

‘আমার পিতার নাম স্যার আক্কাস আলী মণ্ডল।’

‘তার দ্বারা কী বোঝা গেল?’

‘স্যার?’

‘তার দ্বারা বোঝা গেল, তোমার পিতা মোড়ল ছিলেন।’

‘না স্যার। জমিজমা কিছু নাই। সে আমাদের দাদা-দাদার দাদার কোনো দিন কিছু ছিল কি না, তা তো জানি না। কিন্তু আমাদের স্যার কিছু নেই তো। বাবা তো দিনমজুরি করে খায়। এই ধরেন আমাকে নিয়েই তাদের যত আশা। আমি তো স্যার বলেছি, তোমাদের চিন্তা করতে হবি না নে, আমার স্যার আছেন। আমাকে তিনি রান্নার কাজ থেকে প্রমোশন দিয়ে সিপাহি করেছেন। তোমরা দোয়া করো। দেশ স্বাধীন হলে তোমাদের অভাব থাকবি নে। কারও অভাবই থাকবে না। আমিও তো সিপাহি হয়েই গিয়েছি। দেশ স্বাধীন হলে স্যার মানুষ কি আর না খেয়ে কষ্ট পাবি স্যার?’

‘না। তা কেন পাবে?’

‘স্যার, মা বলিছেন, মা আপনের জন্যি অনেক দোয়া করেন। নামাজের শেষে নামাজের জায়গায় বসেই দোয়া করেন।’

‘কবে বললেন তিনি তোমাকে এত কথা?’

‘আমি স্যার গেলাম না মার্চ মাসের শেষের দিকে। চট্টগ্রাম থেকে চলে গেলাম তো ঝিনাইদহে। সেখান থেকে ধরেন আমাদের কালীগঞ্জের খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে। অল্পের জন্যে না সেই রাতে বেঁচে গেলাম। আপনিও বাঁচলেন, আমাদেরও বাঁচালেন। আগে থেকেই তো বলে রেখেছিলেন যে ওরা আক্রমণ করার আগেই আমরা রিভল্ট করব। তবু তো স্যার কত বাঙালি জওয়ান আর অফিসারকে পাঞ্জাবিরা মেরে ফেলল। আমরা না হয় আপনার অর্ডারে আর বুদ্ধি-বিবেচনায় সটকে যেতে পারলাম। তবে স্যার আমি প্রথমে বাড়ি গিয়েছিলাম।’

‘ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলে। তাই আমাদের বিদ্রোহী দলে না এসে ঝিনাইদহ চলে গেলে।’

হামিদুর লজ্জা পান। গোধূলির আলোয় তাঁর মুখখানা আরও লাজরাঙা হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘না। ভ্যাবাচেকা খাই নাই। মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল। ঝিনেদাতে স্যার মুজাহিদ বাহিনীতে জয়েন করেছিলাম। লেখাপড়া তো বেশি দূর করিনি। ক্লাস ফাইভ পাস দিয়েছি। পরে গিয়েছিলাম হাইস্কুলে। পড়াশোনা করার সামর্থ্য তো ছিল না স্যার। বাবা দিনমজুর। বোঝেনই তো। জয়েন করলাম মুজাহিদ বাহিনীতে। সেখানেই দেখি, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা ট্রেনিং করছে। কী সুন্দর মার্চ করে, পিটি-প্যারেড করে। খোঁজখবর নিয়ে আমিও জয়েন করে ফেললাম। সেখান থেকে ট্রেনিং করতে চলে গেলাম চট্টগ্রামে। ট্রেনিং আর কী। খালি গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর। শেখ সাহেব তো দেশ স্বাধীন করে ফেলবেই। পাঞ্জাবিরা বিদায় নিবে। যদি দরকার হয় আমরা হাতিয়ার হাতে নিব। শেখ সাহেব একবার হুকুম দিলেই হয়। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। আমরা তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম স্যার। তাই ভ্যাবাচেকা খাই নাই। কিন্তু মায়ের মুখটা মনে পড়ল। মা তো স্যার। আমারে দেখতে চায়। চট্টগ্রামে মেস থেকে বের হব, দেখি হলুদ পোস্টকার্ড। মায়ের চিঠি। মা লেখাপড়া তেমন জানে না। তবু চিঠি লেখে। লিখছে, বাবা হামিদুর, তোমাকে কত দিন দেখি না। মনটা পোড়ে। দেশের পরিস্থিতিতেও তোমাকে নিয়া ভাবনা হয়। চিঠিটা পড়ে ভাবলাম, দেশের লাইগে যুদ্ধে তো যাবই। যাই, মায়ের মুখটা একটু দেখে আসি। মায়ের দোয়া হলো আসল দোয়া। কী বলেন স্যার।’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আরেকটা প্রশ্ন ছিল স্যার।’

‘আরও একটা প্রশ্ন! রাতের বেলা ডালটা তুমি রাঁধবে তো, হামিদুর?’

‘অবশ্যই স্যার। ডাল রাঁধব। আজ রাতে রুটি না স্যার। ভাতই পাক করব স্যার। আপনে আমার হাতের পাক পছন্দ করেন। আপনি আমাকে বাবুর্চি থেকে সিপাহিতে প্রমোশন দিয়েছেন। আপনি যা বলবেন, আমি তা-ই করব স্যার। আপনি বললে এখনই জান দিয়ে দেব। ধরেন স্যার পাকিস্তানি ট্যাংক আসতেছে। আপনি বললেন, যাও হামিদুর, এই মাইন বুকে বেঁধে ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ো। লাই ডাউন। আমি বলব, ইয়েস স্যার। থ্যাংক ইউ স্যার। জয় বাংলা। আমি আল্লাহর নাম নিয়ে শুয়ে পড়ব।’

‘তা তুমি করবে আমি জানি।’

‘চট্টগ্রামে ট্রেনিং একাডেমিতে আমাদের বাঙালি অফিসারদের আর জোয়ানদের স্যার ২৫ মার্চ রাতে যেভাবে ওরা পাইকারিভাবে ক্লোজ করে লাইন করে গুলি করেছে...আমাকে স্যার অর্ডার দেন, আমি এখনই চলে যাব...মাইন দেন...গ্রেনেড দেন...।’

‘ঠান্ডা হও হামিদুর। এক দিনে লড়াইয়ে জেতা যায় না। একটা একটা করে ব্যাটল লড়তে হয়। অনেক ব্যাটলে তুমি সামনে এগোবে। অনেক ব্যাটলে পেছনে হটবে। আসলে তুমি জিততে চাও ওয়ার। রাইট?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘তোমার প্রশ্নটা কী ছিল যেন?’

‘স্যার। কঠিন একটা কথা বলব স্যার। রাগ করবেন না। মাতৃভূমি জিনিসটা কী স্যার। মাতৃভূমি মানে সবাই বলে মায়ের ভূমি। মাতৃভাষা সবাই বলে মায়ের ভাষা। আমার মায়ের ভূমি তো স্যার ইন্ডিয়া। আবার আমার দেশ তো বাংলা।’

১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হামিদুর রহমানের কোম্পানির সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধে মুখোমুখি হয় ধলুইয়ের এখানেই, ২৮ অক্টোবর ১৯৭১
১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হামিদুর রহমানের কোম্পানির সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধে মুখোমুখি হয় ধলুইয়ের এখানেই, ২৮ অক্টোবর ১৯৭১

সূর্যের আলো কমে আসছে। আকাশে ঝাঁক বেঁধে পাখিরা ঘরে ফিরছে। আর্মি ব্যাটালিয়নের মতো একজন তার পিছে দুজন তার পিছে তিনজন—এই অর্ডারে পাখিরা উড়ছে। মাথার ওপরে একটা কামরাঙাগাছ। টিয়া পাখি ঝাঁক বেঁধে হল্লাচিল্লা করা শুরু করেছে।

ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলেন, ‘শোনো। তোমার প্রশ্নের উত্তরটা আমি আগে থেকে জানি। তাই উত্তরটা দিতে পারলাম। মাতৃভূমি মানে মায়ের ভূমি নয়। মাতৃভূমি মানে দেশ আমার মা। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা নয়। মাতৃভাষা মানে ভাষা আমার মা।’

সিপাহি হামিদুর রহমান, সৈনিক নম্বর ৩৯৪৩০১৪, হাঁ করে শোনেন।

‘ধন্যবাদ স্যার। আমি আমার মনের মধ্যে উথালপাতাল করা সওয়ালের জওয়াব পেয়ে গেছি।’

‘কী পেলে?’

‘বাংলাদেশ আমার মা স্যার। আমার মা আজ বন্দিনী। তাকে মুক্ত করাই আমার কাজ। এই জন্য নিজের জীবন দান করতে পারা গৌরবের কাজ হবে স্যার। আমার মা কায়েদাতুননেসাও তাইলে খুশি হবেন।’

‘যাও হামিদুর। আজকের রাতের খাবার রান্নাটা তুমি একটু টেককেয়ার কোরো।’

‘স্যালুট স্যার। আমি নিজ হাতে পাক করব স্যার।’

হামিদুর লঙ্গরখানার দিকে যান। স্যারের জন্য তিনি আজকে ভাত রাঁধবেন। মুরগি জোগাড় করতে হবে। এই শিবিরে খাবারের অবস্থা তেমন ভালো নয়। রাতে দুটো করে রুটি আর খোসাসমেত ডাল। দুপুরে ভাত আর সবজি। মাছ বা মুরগি সপ্তাহে দুই দিন। নিজেদের প্রতিদিনের ভাতা থেকে চাঁদা দিয়ে তাঁরা মাঝেমধ্যে একটু ভালো খাওয়ার চেষ্টা করেন। কাইয়ুম বলেন, খাওয়া ভালো দরকার সৈনিকদের। তাহলে তারা যুদ্ধটা ভালোমতো করতে পারবে।

অক্টোবর মাস। ২৮ তারিখ। হেমন্তের এই দিনেই এবার শীত পড়েছে ভয়ংকর। সারা রাত কুয়াশায় ঢাকা থাকে চা-বাগান, ছায়াবৃক্ষ আর পাহাড়ের ঢাল ভরে থাকা বিচিত্র বৃক্ষরাজি। এরই ফাঁক দিয়ে বয়ে যায় স্রোতস্বিনী পাহাড়ি ঝরনা। দুপুরের দিকে রোদ পড়লে দূর থেকে মনে হয় গলে যাওয়া রুপার বিছা যেন কোনো পাহাড়ি রমণীর শ্যামল কোমর ঘিরে ঝকমক করছে।

সীমান্তের ওপারে শ্রীমঙ্গলের ধলুই। সেখানে পাকিস্তানি পোস্ট। ওই পোস্ট আক্রমণ করা হবে। দখলমুক্ত করা হবে ধলুই। সেখানে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-হলুদ-সবুজ পতাকা।

ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের নেতৃত্বে চলেছে মুক্তিবাহিনীর দল। কুয়াশার আড়ালে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে যাওয়া সহজ হবে। ওরা টেরও পাবে না। তিন দিক থেকে ঘিরে ধরবে ওরা শত্রুদের। পেছনের দিকটা খোলা রাখবে যাতে শত্রুরা পশ্চাদপসরণ করতে পারে।

তাদের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ আছে পর্যাপ্ত। এই যুদ্ধে জয়লাভ না করার কোনো কারণ নেই। তবে যথাসম্ভব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

তাদের মুক্তিসেনার দলে এবার থাকছেন সিপাহি হামিদুরও। রান্নার কাজ থেকে প্রমোশন দিয়ে তাঁকে কাইয়ুম তাঁর রানার বানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমে মুজাহিদের ট্রেনিং পাওয়া আর পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রেনিং তাঁর মনোবল আর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি তাই সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া শুরু করেছেন। কোদালকাঠির যেখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ, সেখানে কদিন আগে হঠাৎ আক্রমণ করেছিল পাকিস্তানিরা। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্যদের লড়াই হলো। সেই লড়াইয়ে হামিদুর ভালো করেছেন। অল্প বয়স, শরীর-স্বাস্থ্য সুঠাম আর বেসিক ট্রেনিং অনেক এফএফের চেয়ে ভালো। যোদ্ধা হিসেবে তাই তাঁর ভালো করারই কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁর সাহস আছে, তিনি কথা শোনেন, যা বলা হবে তা-ই পালন করবেন। এমন সৈনিকই তো অধিনায়কদের প্রথম পছন্দের।

কুয়াশার চাদরে ঢেকে তাঁরা ধীরে ধীরে পা রাখেন পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে। ধলুই পোস্টটার চারদিকে গাছগাছালি কেটে তারা পরিষ্কার করে রেখেছে। সেটা ১৬০০ বর্গগজের বেশি জায়গা নয়।

কিন্তু তার চারপাশে চা-বাগান, পাহাড়ের চড়াই-উতরাই, গাছগাছালি প্রচুর। আক্রমণ করার জন্য আদর্শ জায়গা। অসুবিধা হলো, নিজেদের পোস্টটা পাকিস্তানিরা বানিয়েছে উঁচুতে। সেখান থেকে গুলি ছুড়লে নিচের আক্রমণকারীরা অসুবিধায় পড়বেই।

তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলা সম্পন্ন। কাইয়ুম প্রথম ফায়ারটা করবেন। তারপর তিন দিক থেকে একযোগে প্রচণ্ড আক্রমণ করবেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রথমেই প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করলে অনেক সময় কাজ হয়। শত্রুরা শক্তির প্রচণ্ডতা আঁচ করে সহজেই রণে ভঙ্গ দেয়।

কিন্তু কুয়াশা এত নিচু হয়ে আছে যে ঠিকভাবে ওদের পোস্টটা দেখা যাচ্ছে না। গাছের ওপরে আলো ফুটে আছে। কিন্তু মানুষসমান উচ্চতায় কুয়াশা। তাঁরা সামনে কিছুই দেখছেন না।

একটা উপায় আছে। একজনকে গাছে তুলে দেওয়া।

তিনি ওপর থেকে দেখুন, ঠিক কোন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটিটা।

একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলে উঠে পড়েন গাছে, ‘স্যার, ঠিক এই বরাবর স্যার।’

বলতে না-বলতেই শত্রু বাহিনী গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুহূর্তেই গর্জে ওঠে কাইয়ুমের রাইফেল। আর তিন দিক থেকে শত্রু বাহিনীর গুলির উৎস অভিমুখে একযোগে পাল্টা গুলি চালাতে থাকে মুক্তিবাহিনী।

উভয় পক্ষ গুলি চালাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী এগোতে পারছে না। ওদের এলএমজি পোস্টটা বড় জ্বালাচ্ছে। ঠিকমতো বসিয়েছে তারা এলএমজি। সেই এলএমজির নাগালের মধ্যে কিছুতেই ঢোকা যাচ্ছে না।

না, আর তো সহ্য করা যায় না। আজ যে করেই হোক, ধলুই তারা শত্রুমুক্ত করবেই।

একটাই করণীয়।

একজনকে সাহস দেখাতে হবে। ক্রলিং করে যেতে হবে পোস্টের একেবারে হাতের নাগালে। হ্যান্ডগ্রেনেড ছুড়ে মারতে হবে এলএমজি পোস্টের বাংকারে। তাহলেই নিষ্ক্রিয় হবে শত্রুর এলএমজি। তারপর ধলুই দখল মুহূর্তকয়েকের ব্যাপার।

ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তখন একটা নালার ভেতরে। দুপাশে নলখাগড়া, ঢোলকলমি, কলমিলতা, ধইঞ্চা, লজ্জাবতী, শটির ঝোপঝাড়। দু-একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ে জোঁক গেঁথে বসেছে। নলিনের কনুই ছিঁড়ে গেছে কাঁটা গাছে। রক্ত ঝরছে। কিন্তু যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে এগুলো কোনো খেয়াল করার মতো ব্যাপারই নয়।

মাথার ওপর দিয়ে শাঁই করে শাঁই করে গুলি উড়ে যাচ্ছে।

পাখিরা আর্তনাদ করে উড়ে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে যেদিকে পারে।

কাইয়ুম বললেন, একজন সাহসী জওয়ান আমার দরকার। কে যাবে? এলএমজি পোস্টে যাবে পেছন দিক দিয়ে। ক্রল করে, চা-পাতা, ঝোপঝাড়ের আড়ালে দ্রুত। দুটো গ্রেনেড দিচ্ছি সঙ্গে। বাংকারের ভেতরে গ্রেনেড ছুড়তে হবে। এলএমজিটা থামিয়ে দিতে পারলেই উই উইল ব্রেক ইন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তিন দিক থেকে একযোগে ঢুকে যাব। ওদের বাকি লোকেরা তখন পালানোর পথ পাবে না। ওদের এলএমজি পোস্ট হবে আমাদের এলএমজি পোস্ট। কে যাবে?

হামিদুর বললেন, ‘আমি যাব স্যার।’

সময় নেই। দুটো গ্রেনেড দ্রুত তুলে দেওয়া হলো হামিদুরের হাতে।

হামিদুর ক্রল করছেন গুইসাপের মতো। কিন্তু দ্রুত। চা-পাতা নড়ছে। বিষকাটালির ঝোপ দুলছে।

ডান দিক থেকে হঠাৎ আক্রমণ। শত্রু বিভ্রান্ত।

বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন কাইয়ুম। কুয়াশাটা কি আজকে যাবেই না, না যাওয়াই ভালো। তাহলে কুয়াশার আড়ালে হামিদুর পৌঁছে যেতে পারবেন শত্রুর পোস্টে।

দ্রিম দ্রিম। দুটো গ্রেনেড চার্জের শব্দ।

তারপর স্তব্ধতা। মানে এলএমজি পোস্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।

এক দল মুক্তিবাহিনী ছুটে গেল এলএমজি পোস্টে। তখনো সেখানে ধোঁয়া উড়ছে।

কিন্তু হামিদুর কই?

এলএমজি পোস্টের ১০ গজ নিচে পড়ে আছেন হামিদুর। রক্তে তাঁর কাঁধ ভেসে যাচ্ছে। পেটের দিকটায় রক্তের বন্যা।

কথা বলতে পারলেন না হামিদুর। স্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু।

মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর দেহ কাঁধে তুললেন। নিয়ে এলেন তাঁকে আম্বাসার হাসিমারা ছড়ায়। ত্রিপুরা জেলায়।

সেখানেই কবরস্থ করা হলো তাঁকে। কাঁচা মাটি দেওয়া হলো তাঁর দেহের ওপরে। দেশের মুক্তির জন্য তিনি শহীদ হয়েছেন।

২৮ অক্টোবর যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা শেষ হলো ১ নভেম্বর। ধলুই শত্রুমুক্ত হলো। সেখানে উড়িয়ে দেওয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

এরও বহুদিন পর হামিদুরকে মনে পড়ল কাইয়ুমের। মনে হলো, হামিদুর কি শেষ কোনো কথা বলতে চেয়েছিলেন অন্তিম মুহূর্তটিতে?

একসময় হামিদুর তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মাতৃভূমি কী। তিনি বলেছিলেন, দেশই হলো মা।

হামিদুর কি মায়ের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন? তিনি কি চেয়েছিলেন তাঁর শেষ আশ্রয় হোক মায়ের কোলে? কবরটা হোক দেশের মাটিতে?

শহীদ হওয়ার ৩৬ বছর পরে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কবর উত্তোলন করে ত্রিপুরা থেকে ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেন কাইয়ুম—যিনি পরে মেজর হয়েছিলেন—তাঁর মনে হয়, হামিদুর তাঁর মায়ের কাছে ফিরে আসতে পেরেছেন।

হামিদুর রহমান

জন্ম

২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩

মৃত্যু

২৮ অক্টোবর ১৯৭১

জন্মস্থান

খর্দ্দ খালিশপুর, মহেশপুর, ঝিনাইদহ

যোদ্ধা

১ম ইস্ট বেঙ্গলের সি কোম্পানি

যুদ্ধ

সিলেটের শ্রীমঙ্গলের ধলুই সীমান্তে

পদবি

সিপাহি

সমাধি

প্রথমে ত্রিপুরার হাসিমারায়।

পরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে