ইউসুফ চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধ

বাবা ইউসুফ চৌধুরীর কোলে ছোট রহিমা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
বাবা ইউসুফ চৌধুরীর কোলে ছোট রহিমা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। উৎকণ্ঠায় বিলাতপ্রবাসী বাঙালিরা। অন্যদের চেয়ে হয়তো একটু বেশিই উৎকণ্ঠিত হলেন ইউসুফ চৌধুরী। সিলেটে নিজেদের বাড়িতে বছরখানেক আগে তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়ে রহিমাকে রেখে গেছেন। কোনোভাবেই মেয়ের খোঁজ জানতে পারছিলেন না। লন্ডনে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির মাধ্যমে খোঁজ নিলেন বার কয়েক, সেই চেষ্টাও ব্যর্থ। সিলেট নগরীর লতিপুর গ্রামে কাউকে খুঁজে পাননি রেডক্রসের কর্মীরা। মেয়েকে ফিরে পেতে তখন পাগলপ্রায় ইউসুফ।

যুদ্ধের মধ্যেই দেশে যেতে উদ্গ্রীব ইউসুফ, সায় পেলেন না পরিচিতজনদের কাছে। উচাটন মনকে আর দমাতে পারলেন না। কাউকে না জানিয়েই দেশে পাড়ি দিলেন। ৮ এপ্রিল কুয়েত এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট ধরে ভারতের মুম্বাই যান। ১৫ এপ্রিল পৌঁছান সিলেটের কাছের শহর করিমগঞ্জে। শহরের চিত্রবাণী সিনেমা হলে গিয়ে দেখা করেন দীর্ঘদিনের বন্ধু শিল্পী বিদিত লাল দাসের সঙ্গে। থাকার জায়গা হলো গৌরী হোটেলে। শরণার্থীশিবিরে গিয়ে জানাশোনা কজনের সঙ্গে দেখা, তবে মেলেনি রহিমার খোঁজ। পরদিন সন্ধ্যায় হোটেলের মালিক সাহা বাবুর দেওয়া লুঙ্গি আর শার্ট পরে রওনা দিলেন ৩০ মাইল দূরের শহর সিলেটের দিকে।

পথে পথে দেখা হলো সীমান্ত পাড়ি দিতে চলা সহায়হীন অনেক মানুষের সঙ্গে। খবর পেলেন তাঁর গ্রামে কেউ নেই। নানা গ্রামে ঘুরে বিভ্রান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়েন ইউসুফ। শেষতক দুই সপ্তাহ পর এক সন্ধ্যায় লতিপুর থেকে আট মাইল দূরে আত্মীয়ের বাড়িতে দেখা পেলেন মেয়ে রহিমার। রাত পোহালে মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিলেন করিমগঞ্জে।

রহিমাকে নিয়ে ভারতের শরণার্থীশিবির, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পসহ নানা জায়গায় ঘোরাফেরা আর ছবি তুলে কাটালেন প্রায় দুই মাস। জুলাই মাসের শেষ দিকে বার্মিংহামের এজবাস্টন এলাকার হ্যালম স্ট্রিটের বাড়িতে পৌঁছালেন বাবা-মেয়ে। দলবেঁধে স্থানীয় বাঙালি-অবাঙালিরা দেখতে আসতে লাগলেন তাঁদের।

যুদ্ধের এই ভয়াল পরিস্থিতির মধ্যে মেয়েকে ফিরে পাওয়া আর তাকে নিয়ে ফেরার রোমাঞ্চকর গল্প ছাপা হয় যুক্তরাজ্যের মূলধারার বিভিন্ন পত্রিকায়। ওই সময় ইভিনিং মেইল পত্রিকাকে দেওয়া ‘ফাদার ট্রেক থ্রু টেরর টু সেইভ হিজ চাইল্ড’ শিরোনামে এক সাক্ষাৎকারে ইউসুফ চৌধুরী বলেন, ‘আমি শুধু আমার মেয়েকে ফিরে পেতে চেয়েছি। আমি যেটি করেছি, যেকোনো বাবাই তাঁর সন্তানের জন্য এমনটি করতেন। বাবা হিসেবে সন্তানকে কীভাবে এমন বিপদে ফেলে রাখি? যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি রহিমার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম, কখন কী হয়। স্বাভাবিক চিঠিপত্র আসত, খবর পেতাম সব সময়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা আমাকে পাগল করে তোলে। রহিমাকে কাঁধে নিয়ে আবার ঘুরব এই স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস নিয়েই ছিল আমার অনিশ্চিত যাত্রা।’

যুক্তরাজ্যের ইভিনিং মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত সেই খবর
যুক্তরাজ্যের ইভিনিং মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত সেই খবর

ইউসুফের ক্যামেরায় আগুনঝরা দিন

মেয়েকে নিয়ে বিলাত ফেরার পর আবারও রাজপথে ক্যামেরা নিয়ে নামেন ইউসুফ চৌধুরী। তুলতে থাকেন প্রবাসী বাঙালির বাঁধভাঙা স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের ছবি। ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারের সেই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের ছবিও তুলতে পেরেছিলেন তিনি। প্রতিটি ছবিতে রয়েছে চেনা-অচেনা মানুষের মুখ, রাজপথ কাঁপানো সময়ের চিত্র। উত্তাল সেই দিনগুলোতে অসংখ্য ছবি তুলেছেন ইউসুফ চৌধুরী। বিবিসির তৈরি তথ্যচিত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর তোলা ছবি।

বঙ্গবন্ধুর বিলাত সফরের সময় ছবিটি তুলেছিলেন ইউসুফ চৌধুরী, ১৯৬৯
বঙ্গবন্ধুর বিলাত সফরের সময় ছবিটি তুলেছিলেন ইউসুফ চৌধুরী, ১৯৬৯

ছবির মানুষের খোঁজে

দেশ স্বাধীন হলে ইউসুফ খোঁজা শুরু করেন ছবির সেই মানুষদের নাম-পরিচয়। ছবি নিয়ে বিভিন্ন শহরে গিয়েছেন মানুষের কাছে। কষ্টেসৃষ্টে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ধারাবাহিকভাবে তুলে রেখেছেন তাঁর লেখা সন্ধানী চাকা, রুটস অ্যান্ড টেইলস অব বাংলাদেশি সেটেলার, একাত্তরে বিলেত প্রবাসী, সন্স অব এম্পায়ার, বাংলাদেশ টু বার্মিংহাম, দ্য রুটস অব ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্টাল কেটারিং ইন ব্রিটেন নামের বইগুলোতে।

২০০৪ সালে ইউসুফ চৌধুরীর যুদ্ধদিনের ছবি নিয়ে অ্যান অ্যালবাম অব ১৯৭১ বাংলাদেশ লিবারেশন মুভমেন্ট প্রকাশ করে দ্য এথনিক মাইনরিটি অরিজিনাল হিস্ট্রি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, ইউকে। মূলত বিলাতপ্রবাসী লেখক রেনু লুৎফা এবং গবেষক ফারুক আহমদের প্রচেষ্টায় ইউসুফ চৌধুরীর ঐতিহাসিক আলোকচিত্রগুলো অ্যালবাম আকারে প্রকাশিত হয়।

৬ ডিসেম্বর ২০০২ সালে ৭৫ বছর বয়সে মারা যান ইউসুফ চৌধুরী। প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন তাঁর অনন্য কর্ম অ্যান অ্যালবাম অব বাংলাদেশ লিবারেশন মুভমেন্ট। এই বইয়ে নতুন প্রজন্ম জানবে ১৯৭১ সালে বিলাতের রাজপথে ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের এক পূর্বসূরি বীরযোদ্ধা ইউসুফ চৌধুরী। বিলাতে মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে তাঁর ক্যামেরায় তোলা আলোকচিত্রগুলো ভিনদেশে বাঙালির আগুনঝরা দিনের একেক টুকরো গল্প।

সিলেট টু বিলাত

ইউসুফ চৌধুরীর আদিনিবাস সিলেটের অদূরে লতিপুর গ্রামে। মায়ের কোলে থাকতেই হারিয়েছেন বাবাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন রাজা গিরীশ চন্দ্র হাইস্কুলের ছাত্র। যুদ্ধ শেষে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে স্টেশন রোডে খুলে বসলেন বইয়ের দোকান। বিধি বাম, বছর দুই পর বিক্রির চেয়ে ধার করে নেওয়া বইয়ের সংখ্যাই তাঁর বেশি। অতঃপর স্থানীয় কাজীর বাজারে শুরু করলেন মিষ্টির ব্যবসা; এখানেও মুখ ফেরাল বাণিজ্যলক্ষ্মী। ১৯৫৭ সাল; ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিলাত পাড়ি দেন ২৮ বছরের ইউসুফ।

বিলাতের বিভিন্ন শহরে ছিলেন ইউসুফ; শেষ অবধি থিতু হন বার্মিংহাম শহরের স্মলহিথ এলাকায়। কাজ নেন কারখানায় আর শখ ছবি তোলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে বিলাতে গঠিত হয়েছিল ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড’। সেই তহবিল সংগ্রহের চিত্র, সত্তরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে রাস্তায় নামা প্রবাসীদের ছবি ক্যামেরাবন্দী করে চলেন ইউসুফ চৌধুরী।

ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে কারামুক্তির পর বিলাতপ্রবাসী বাঙালিদের কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ অক্টোবর ১৯৬৯ লন্ডনে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। তাঁর সম্মানে ১ নভেম্বর পূর্ব লন্ডনের গ্র্যান্ড প্যালেস হল মিলনায়তনে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। ২ নভেম্বর ছিল বার্মিংহামের ডিগব্যাথ সিভিক হলে বঙ্গবন্ধুর গণজমায়েত। সেদিনও ছবি তুলতে ভুল করেননি আলোকচিত্রী ইউসুফ চৌধুরী।

স্বামী শেরওয়ান চৌধুরীর সঙ্গে রহিমা চৌধুরী এখন
স্বামী শেরওয়ান চৌধুরীর সঙ্গে রহিমা চৌধুরী এখন

রহিমা চৌধুরী এখন

রহিমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৪ সালে। বসবাস লন্ডনের ক্রয়ডনে। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্স হিসেবে কাজ করছেন স্থানীয় ক্রয়ডন স্কুলে। তাঁর স্বামী শেরওয়ান চৌধুরী লন্ডনের ক্রয়ডন কাউন্সিলের পরপর তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর এবং কেবিনেট মেম্বার হোমস অ্যান্ড রিজেনারেশন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের মেয়ে তানভীরা চৌধুরী পেশায় ফার্মাসিস্ট, দুই ছেলে নিউরোসার্জন ডা. ইয়াসির ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাফওয়ান চৌধুরী।

’৭১ সালে বাবার কাঁধে চড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন রহিমা। কেমন ছিল সেই দিনগুলো? রহিমা চৌধুরী বললেন, ‘সেই সময়ের স্মৃতি আমার কাছে অনেকটাই ঝাপসা। বাবার তোলা ছবিগুলো দেখলে সবকিছু রঙিন হয়ে ওঠে। আমি তখন মাত্র ৬ বছরের; বেড়াতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। চাচা তজমুল চৌধুরীর কাছে ছিলাম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, চাচা শুধু বলতেন; তোমারে লন্ডন পাঠিয়ে দেব মা! দেশটা একটু শান্ত হোক। বুঝতে পারি, তাঁরাও আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন।’

এরপর হুট করে একদিন সন্ধ্যাবেলা বাবাকে পেয়েছিলেন। তারপর ভারত হয়ে ফিরে আসেন বিলাতে। রহিমা চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমরা ভারতে ছিলাম আরও দুই মাস। শরণার্থীশিবির, ক্যাম্প—নানা জায়গায় বাবা আমাকে নিয়ে ঘুরতে গেছেন। ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে বাবার কাছে সেই দিনগুলোর গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি।’

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে আবার বাংলাদেশে আসেন রহিমা চৌধুরী। তারপর আসেন আরও কয়েকবার। গ্রামের বাড়িতে গেলেই তিনি সেই দিনগুলোতে ফিরে যান।