যে মুক্তিযোদ্ধা প্রথম কর দিয়েছিলেন

মোহাম্মদ সাইফুল আলম। ছবি: আনিস মাহমুদ
মোহাম্মদ সাইফুল আলম। ছবি: আনিস মাহমুদ

১৯৭১-৭২। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থবছর। একজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধা আয়কর দেন। তিনি মোহাম্মদ সাইফুল আলম। বাড়ি সিলেটের লাউয়াই।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের একটি মহল্লার নাম লাউয়াই। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সংযোগে গলিপথ। এ পথ দিয়ে যেতে হয়। গলিপথে আরও কয়েকটি সরু পথ।

সাইফুল সাহেবের বাড়ি কোন দিকে? পথচলতি একজনের কাছে জানতে চাওয়া।

 ‘আমারার এলাকাত তো সাইফুল আছইন বেশ কয়জন, কোন সাইফুল? কর দিয়া পুরস্কার পাইছইন যে তাইন নি?’

 ‘হ্যাঁ।’

তারপর সঙ্গে করে নিয়ে বাড়িটি দেখিয়ে দিলেন।

একটি মসজিদের পাশে তিনতলা পাকা বাড়ি। তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে আগেই কথা হয়েছিল। তিনিই দিনক্ষণ করেছিলেন। বাড়ির সামনে যেতেই সাক্ষাৎ মিলল। জানালেন, এই মাত্র উপজেলা সমন্বয় পরিষদের মাসিক সভা থেকে এলেন। সেখানেও তাঁকে একই বিষয়ে কথা বলতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রথম করদাতা।

সিলেটে এ বছরের আয়কর মেলায় সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি দীর্ঘমেয়াদি কর প্রদানকারীর সম্মাননাও লাভ করেছেন। সেই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম করদাতাদের একজন তিনি। আয়কর মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে আর্কাইভস তথ্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন কর অঞ্চল সিলেটের কমিশনার সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ। তিনি আর্কাইভস প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন। দেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা করদাতার তথ্য চট্টগ্রামে ইনকাম ট্যাক্স আর্কাইভসে সংরক্ষিত।

কর কমিশনার বলেন, ‘প্রথম অর্থবছরে আমরা একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উনার (সাইফুল) নাম পেয়েছি। আর্কাইভসে তিনিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, যিনি প্রথম আয়কর দিয়েছেন।’

৭ নভেম্বর সিলেটে এ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায়। ২০ নভেম্বর তাঁর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। পরিপাটি কক্ষ। সোফাসেটের টেবিলে রাখা কর সম্মাননার ক্রেস্টসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতির কিছু সংবর্ধনা ক্রেস্ট। আলাদা করা একটি ফাইলে আছে মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্রজীবনের কিছু প্রামাণ্য তথ্য। দেখালেন প্রথম করদাতার সত্যায়িত কপি। তাঁর করদাতা নম্বর ৩৭৬০/১। অর্থবছর ১৯৭১-৭২।

‘আমার যুদ্ধ করা আর কর দেওয়ার পেছনে ছিল একটাই টান, একটাই আহ্বান। তিনি বঙ্গবন্ধু। তাই কর দেওয়ার প্রসঙ্গ এলে মুক্তিযুদ্ধ এসে যায়। যুদ্ধ করলাম। যুদ্ধ জয়ের পর বাড়ি ফিরলাম। ফিরে এসে শুনি আরও এক আহ্বান। বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করতে বললেন। যাঁদের সাধ্য আছে, তাঁদের কর দিতে বললেন। যাঁর ডাকে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে যাই, দেশ স্বাধীনের পর তাঁর আহ্বান কেন ফেলব? নিজের হাতে স্বাধীন করা দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই কর দিছি!’

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়তে সেই যে কর দেওয়া শুরু করেছিলেন, তারপর প্রতিবছরই কর দিয়ে আসছেন। সাইফুল আলম একজন ব্যবসায়ী। তাঁর আয়রন-স্টিলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায়। তিনি দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদেও আছেন। সামাজিক কাজে সক্রিয়তার জন্য গত ২৮ অক্টোবর ‘কমিউনিটি পুলিশিং ডে-২০১৭’ অনুষ্ঠানে তিনি ‘শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য সম্মাননা’ এবং সিলেট মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য হিসেবে ‘আইজিপি পদক’ পেয়েছেন।

ছয় বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে সাইফুল তৃতীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের মদনমোহন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালে উপকূলে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে সিলেটের ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে গিয়েছিলেন। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের শুরু তখন থেকেই। সচেতনভাবে শুনেছেন বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ।

সাইফুল আলম স্মৃতিতাড়িত হলেন। বললেন, ‘ভাষণ তো নয়, যেন বাঘের গর্জন।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ‘বাঘের কণ্ঠ, বজ্রকণ্ঠ’ বলে প্রচার করতেন।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাঁর নিজেকে আর নিরাপদ মনে হয়নি। তরুণদের ধরে নিয়ে হত্যা করার খবর চারদিক থেকে আসছিল। সাইফুল বলেন, ‘আমি পণ করি, মরতে যখন হবে, তখন যুদ্ধ করেই মরব। কিন্তু পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়াল। জুনের মাঝামাঝি একদিন ফজরের নামাজ পড়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হই। মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ি। ইমাম সাহেবকে বলি যুদ্ধে যাচ্ছি। বললাম, সন্ধ্যায় যদি না ফিরি, তাহলে এশার নামাজের পর যেন বাবাকে বলেন।’

সাইফুল আলম বললেন, পায়ে হেঁটে ভারতের করিমগঞ্জ যান। সিলেট থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে জকিগঞ্জ হয়ে যেতে হয় করিমগঞ্জ। পথে ছিল নানা দুর্দশা। সেসব দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাঁর মনে গাঁথা। দুর্দশা কাটানোর একমাত্র মনোবল ছিল বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ।

১৯৭১ সালের ২৫ জুন সাইফুল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শপথ নেন। একটি পুরোনো ফাইল খুলে দেখালেন সেই শপথনামা। মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। কমান্ডান্ট মানিক চৌধুরীর সঙ্গে যুদ্ধ করার স্মৃতি আছে। যুদ্ধ করে পান স্বাধীন দেশ। মনে অন্য রকম আনন্দ। নিজ হাতে যুদ্ধ করে নিজের করে দেশ পাওয়া গেল। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়া হবে কেমন করে? কান পাতেন রেডিওতে। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর একটি আহ্বানই ঘুরেফিরে রেডিওতে প্রচার হতো। সেটি হলো কর দেওয়ার। বললেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিতেই কর দিয়েছেন।

১৯৭১-৭২ অর্থবছরের সত্যায়িত কপি দেখিয়ে সাইফুল বলেন, ‘প্রথম করদাতা আমি তো জানতাম। কর বিভাগ অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতেই চট্টগ্রাম (তখন সিলেট সার্কেল ছিল না) থেকে এটি বের করে এনে এবারই প্রথম প্রকাশ করেছে। আমি ছোটবেলা থেকেই স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। তাই যুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সেই দেশের দায় সারতেই কর দিছি।’

সাইফুল আলম এক ছেলে ও তিন মেয়ের বাবা। মেয়েরা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। একমাত্র ছেলে মো. রাজীব আহসান বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করেন। রাজীব বাবার ইচ্ছেতেই এমবিএ করে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছেন। বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় রাজীবও ছিলেন সঙ্গে। ফাইলপত্র ঘেঁটে নানা তথ্য দেখাচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যে মদনমোহন কলেজ বার্ষিকীতে ছাপা হওয়া তাঁর বাবার লেখা একটি গল্প বের করে দেখাচ্ছিলেন রাজীব। গল্পের নাম ‘রূপাতীত’। ১৯৭০ সালে বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে লিখেছিলেন। ছাত্রজীবনের স্মৃতি হিসেবে প্রকাশনাটি তাঁর সংরক্ষণে আছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। তবু কথা ফুরায় না। বাবাকে নিয়ে বলছিলেন রাজীব। ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কত সুবিধা তো আছে। আবার অনেককে নানা সুবিধার বাইরে আরও সুবিধা নিতে দেখেছি। কিন্তু আমার বাবা ব্যতিক্রম। পড়াশোনা শেষ করে আমি চাকরি করতে চাইছিলাম। বাবা আমাকে ব্যবসার কথা বলেন। একটি কথা সব সময় বলেন। সেটি হচ্ছে নৈতিকতা। ব্যবসায় নৈতিকতা থাকলে দেশ সেবাও যে হয়, বাবাই এর প্রমাণ।’